জামালপুরে ইত্তেফাকের সাংবাদিক মোশাররফের চির বিদায়

S M Ashraful Azom
0
জামালপুরে ইত্তেফাকের সাংবাদিক মোশাররফের চির বিদায়

মো. শাহ্ জামাল: দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক জামালপুর সংবাদদাতা এ.কে.এম. মোশাররফ হুসেন ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নানিল্লাহি....রাজেউন। ১৬ জুলাই সন্ধ্যা ৬টায় শহরের পশ্চিম নয়াপাড়ার নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তিনি জামালপুর জেলার একজন দাপুটে সাংবাদিক হিসেবে সবার কাছেই ছিলেন একজন পরিচিত জন। মোশাররফ হুসেনের পরিচিতি কেথায় প্রকাশিত হয়নি। তাই মোশাররফের বিস্তারিত অনেকের জানা হয়নি। যতটুকু জেনেছি তা এখানে প্রকাশ করা হলো।
মোশাররফ হুসেনের জন্মস্থান ময়মনসিংহের নেত্রকোনা জেলায়। একসময় তাঁর নিজ এলাকায় ন্যাপ (মোজাফফর) রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫৪ সালের দিকে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে মোশাররফ হুসেন রাজনৈতিক মামলার আসামী হন। তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। তিনি গ্রেপ্তার এডাতে জামালপুরের ন্যাপ নেতাদের আশ্রয়ে আত্মগোপনে থাকেন। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও তিনি জামালপুরেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলার পথে রাজনৈতিক সহকর্মীদের সহায়তায় তিনি জামালপুর শহরের ফিরোজা বেগম নামে এক মেয়েকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকেই তিনি জামালপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
দেশ স্বাধীনের পর তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন এবং রাজনীতি থেকে পুরোপুরি ছিটকে পড়েন। ৮০ দশকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে পাহাড়ী-বাঙ্গালীর মধ্যে সম্প্রীতির মাধ্যমে সহবস্থান কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় তিনি বান্দারবানে পাড়ি জমান। পাহাড়ী আবহাওয়ার প্রতিক‚ল পরিবেশের কারণে তিনি ৪ বছর পর আবারো জামালপুরে এসে কিছুদিন তিনি জীবন বীমা কর্পোরেশনে কাজ করেছেন।
এরপর তিনি দৈনিক বাংলার বাণীতে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের জামালপুর সংবাদদাতা হিসেবে যোগদান করেন। মোশাররফ হুসেন প্রায় ৪০ বছর দাপটের সাথে সাংবাদিকতা করেন। ইত্তেফাকের একজন দাপুটে সাংবাদিক হিসেবে প্রশাসনসহ সর্বমহলে সুনাম অর্জন করেন। পেশাগত কাজে তিনি বহু প্রতিক‚লতার সম্মুখীন হন। হামলা-মামলা-ষড়যন্ত্রের যাঁতাকলের শিকার হলেও তিনি থেমে যাননি। জামালপুর প্রেস ক্লাব ও জেলা প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠায় অন্যান্যদের ন্যায় তিনিও অবদান রাখেন।
তিনি জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা জামালপুর জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতার জীবনে তিনি জামালপুর থেকে সাপ্তাহিক আবাহন নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন। এর আগে তিনি দৈনিক সচেতনকণ্ঠ পত্রিকার কাজে অনেক সহযোগিতা করেন। কর্মময় জীবনে তাঁর নানাদিক-নানা কর্মের আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও; তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিক-নির্যাতন প্রতিরোধে সংগ্রাম, মিছিল, মিটিংসহ আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি সকল রাজনৈতিক দলের কাছেই আস্থাভাজন ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ২ ছেলে ২ মেয়ের জনক।
বার্ধ্যক্ষ-অসুস্থ হবার পরও তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের হাল ছাড়তে নারাজ ছিলেন। সহকর্মীদের সর্বাত্বক সহযোগিতার মাধ্যমে তিনি ইত্তেফাকের সংবাদ প্রকাশে গতিশীল রাখেন। সকল সহকর্মীদের অগোচরে ঘটাকরেই দৈনিক ইত্তেফাক থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। এতেই শেষনয়, তাঁর স্থালাভিষিক্ত এস.এম. আব্দুল হালিম দুলাল নামে একজনকে ইত্তেফাকের জেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য সুপারিশসহ অনাপত্তিপত্রেও স্বাক্ষর করেন। তখনো ইত্তেফাক অফিসে তার দেনা-পাওনা ছিল।  ঘটাকরে ইত্তেফাক থেকে অবসর নেয়ার খবরে জেলার সাংবাদিক-সূধি মহল এমনকি পরিবারের অনেকেই মোশাররফের প্রতি অভিমান করেন।
ইতোমধ্যেই তিনি একদিকে দৈন্যদশা অপরদিকে তাঁর রোগ বৃদ্ধি পায়। জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি শফিক জামান লেবুর তত্ত¡াবধানে অন্যান্য কর্মকর্তারা গোপনে প্রায়ই সাংসারিক এবং চিকিৎসার জন্য খবরদারি করতেন। কিছুদিন চলার পর মোশাররফের একান্ত সহচরদের মধ্যে জেলার বর্ষিয়ান সাংবাদিক শফিক জামান লেবুর মৃত্যুর পর তিনি মানষিকভাবে আরো ভারাক্রান্ত-দুর্বল হয়ে পড়েন। মোশাররফের পরিবারের পুরো সাংসারিক না হলেও; মাঝে মাঝে জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি এম.এ. জলিলের তত্ত¡াবধানে সীমিত সহায়তা অব্যাহত থাকে।
ওদিকে জামালপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাফিজ রায়হান সাদার পরিবারের সাথে সাংবাদিক মোশাররফ পরিবারের সখ্যতা ছিল দীর্ঘদিনের। সেই সুবাদে হাফিজ রায়হান সাদাও মোশাররফ পরিবারের খোঁজখবরসহ সহায়তা করতেন। মোশাররফের বড় মেয়ে ফিরোজা বেগম নিভার পিত্তে পাথর অপারেশন দরকার। এ ছাড়াও ছোট মেয়ে মিতু আক্তার কিডনিজণিত রোগে কাতরাচ্ছেন। সংসারের উপার্জনক্ষম বলতে আফরোজা বেগম নিভা পৌরসভায় মাস্টার রোলে চাকরি করেন। মাসিক ৫ হাজার টাকায় চলে পুরো সংসার। শুধু মোশাররফের ওষুধ কেনার জন্য মাসিক কমপক্ষে প্রায় ৩হাজার টাকার প্রয়োজন হয়। অন্যান্য খরচতো আছেই। মেয়ের মাত্র ৫ হাজার টাকায় কিভাবে চলবে সংসার তানিয়ে পুরো পরিবার হতাশায় দিনাতিপাত করছিলেন। উপার্জনক্ষম একমাত্র পূত্রও পিতার খবর নিতেন না।
মিতু একটি এনজিওতে চাকরি করতেন। অসুখের কারণে চাকরিও চলে গেছে। মিতুরও কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য কমপক্ষে ৪ লাখ টাকার প্রয়োজন। নিজেদের জমাকৃত টাকা ছাড়াও বাসার একাংশ জমি বিক্রি করে টানা দুই বছর চিকিৎসা ও সংসার চলার পর নিঃস্ব হন। তখন মোশাররফ পরিবারে অনটন প্রকট আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় করোনার প্রভাবে মোশাররফ পরিবারের প্রতি খবরদারিও ভাটা পড়ে। শুরু হয় মোশাররফ পরিবারে অর্ধাহারে-অনাহারে চিকিৎসাবিনে দিনাতিপাত।
সাংবাদিক মোশাররফের দুরবস্থার খবরটি ইউটিউব চ্যালেন ওয়ান বাংলায় প্রথম প্রকাশ করেন সাংবাদিক সৈয়দ শওকত জামান। পরে মোশাররফের খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। খবরের প্রেক্ষিতে জামালপুর আ’লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাংবাদিক মোশাররফকে ১৫হাজার টাকা প্রদান করেন। একই সময়ে জামালপুর সমিতি ইউকের সভাপতি সৈয়দ শামীম জামান আরো ৪০ হাজার টাকা প্রদান করেন। সাংবাদিক মহলও তাঁর পাশে দাড়ায়।
এ ব্যাপারে জেলা প্রেস ক্লাবের প্রয়াত সভাপতি শফিক জামান লেবুর আমলে ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শুভ্র মেহেদী বলেন-সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে মোশাররফ সাহেবের জন্য ১ লাখ টাকা অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় জামালপুরের আরো তিন সাংবাদিক মোস্তফা বাবুল ২লাখ, আমিনুল ইসলাম লিটন পঞ্চাশ হাজার এবং জাহিদ সাহেব ১ লাখ টাকা অনুদান বরাদ্দ পান।
ওদিকে ১৬ জুলাই/২০২০ মোশাররফ ভাইয়ের অবস্থার খোঁজ নিতে বাসায় করি। মিতু ফোন রিসিভ করে বলেন-বাবার অবস্থা ভালো না। হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। এর দুই ঘন্টার মধ্যে মৃত্যুর খবর পাই। ওইদিন সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের বরাদ্দকৃত ১লাখ টাকা ডিসির অফিস থেকে উত্তোলনের ফরম পূরণের তোড়জোড় চলছিল। ঠিক ওই সময়ে সাংবাদিক মোশাররফের অবস্থা কাঁবু হয়। দ্রæত জামালপুর হাসপাতালে নেয়া হলেও; তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
মুহুর্তেই সাংবাদিক মোশাররফের মৃত্যুর খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সাংবাদিকসহ সর্বমহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। রাত সাড়ে ১০টায় জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ মাঠে জানাজা নামাজ শেষে কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জানাজা নামাজে উপস্থিত ছিলেন-তথ্যপ্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান এমপি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক পাট-বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী আলহাজ মির্জা আজম এমপি, আশেক মাহমুদ কলেজের অধ্যক্ষ-লেখক মোজাহিদ বিল্লাহ ফারুকী, জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র এড. শাহ মো. ওয়ারেছ আলী মামুন, জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি এম.এ. জলিল, মরহুমের স্বজনসহ এলাকাবাসি। জানাজা নামাজের আগে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পর্বের উপস্থাপনা করেন-জামালপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাফিজ রায়হান সাদা।
তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান এমপি এবং আলহাজ মির্জা আজম এমপি জানাজা নামাজের আগে প্রয়াত সাংবাদিক মোশাররফের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা শেষে তাঁর জন্য বরাদ্দকৃত টাকা তাঁর পরিবারের হাতে হস্তান্তরের আশ^াস দেন। একই সাথে মোশাররফের মেয়ে নিভার মাস্টার রোলের চাকরিও স্থায়ীকরণের উপর গুরুত্বারোপ করেন। জানাজা নামাজে জেলার শীর্ষ সাংবাদিকবৃন্দ ছাড়াও সূধিজনরা উপস্থিত ছিলেন।
জেলার সাংবাদিক নেতা হাফিজ রায়হান সাদা এবং এম.এ. জলিল প্রয়াত সাংবাদিক মোশাররফ হুসেন সম্পর্কে স্মৃতিচারণে বলেন-এই দাপুটে সাংবাদিককে হারানো মানে একটা সম্পদ হারালাম। মোশাররফের শুন্যতা আর পূরণ হবার নয়। প্রয়াত সাংবাদিকের অসুস্থ দুই মেয়েরও অবস্থা ভালো না। সাংবাদিক নেতাদ্বয় শোকসনতপ্ত সাংবাদিক পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। একই সাথে মোশাররফ পরিবারের প্রতি সুনজর রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

লেখক:
দৈনিক ইত্তেফাক সংবাদদাতা
মানবাধিকার কর্মী ও সদস্য
জামালপুর জেলা প্রেস ক্লাব।

ভিডিও নিউজ


-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন


ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top