ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের আবাসন খাত

S M Ashraful Azom
0
ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের আবাসন খাত

সেবা ডেস্ক: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের ধাক্কা কাটিয়ে আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ক্রেতারা ফ্ল্যাটের খোঁজখবর নিচ্ছেন। তাতে অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠানের ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে করোনার আগে যে বিক্রি ছিল, গত দেড় মাসে তার কাছাকাছি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। অনেকের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ২০-৩০ শতাংশ কম। তবে বিক্রি শুরু হওয়ায় নতুন প্রকল্পও নিতে শুরু করেছে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো।

আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজেটে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা (অপ্রদর্শিত অর্থ) বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়ায় করোনাকালের মধ্যেই ফ্ল্যাট বিক্রিতে গতি এসেছে। ব্যাংকঋণে সুদের হার হ্রাস পাওয়ার কারণেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে সব আবাসন প্রতিষ্ঠানের ফ্ল্যাটই যে বিক্রি হচ্ছে, তা নয়। তারপরও ক্রেতাদের আনাগোনা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন ব্যবসায়ীরা।

দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন। তারপর মার্চের শেষ দিকে করোনার সংক্রমণ রোধে দেশজুড়ে লকডাউন বা অবরুদ্ধ অবস্থা জারি করা হয়। তাতে আবাসন ব্যবসায় ভয়াবহ ধস নামে। তখন ফ্ল্যাট বিক্রি তো দূরে, গ্রাহকদের কাছে কিস্তির টাকাও পায়নি প্রতিষ্ঠানগুলো। সেই সঙ্গে প্রকল্পের নির্মাণকাজও বন্ধ হয়ে যায়। মে মাসে সীমিত আকারে ব্যবসা খুললেও খুব কমসংখ্যক ক্রেতার দেখা পায় প্রতিষ্ঠানগুলো।

বাজেটে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ায় দেশের বাইরে টাকা যাচ্ছে না। তাতে আবাসনে বিনিয়োগ আসছে। ফ্ল্যাট বিক্রি বৃদ্ধির পেছনে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগটি বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।
তানভীরুল হক প্রবাল, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিল্ডিং ফর ফিউচার
জুন থেকে একটু একটু করে পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করলেও জুলাইয়ে গতি বাড়ে। করোনায় নির্মাণকাজ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় প্রকল্প সম্পাদন ও ফ্ল্যাট হস্তান্তরের সময়সীমা দেড় বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব। এতে করে যেসব ক্রেতা করোনার আগে চলমান প্রকল্পের ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছিলেন, তাঁদের ফ্ল্যাট বুঝে পেতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় লাগতে পারে।

আবাসন খাতের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বিল্ডিং ফর ফিউচার লিমিটেড। গত মাস থেকে প্রতিষ্ঠানটির ফ্ল্যাটের বিক্রি বেড়েছে। অনেক ক্রেতা ফ্ল্যাট কেনার জন্য খোঁজখবর নিচ্ছেন। অনেকটা স্বাভাবিক সময়ের মতোই বিক্রি হচ্ছে তাদের।


বিষয়টি নিশ্চিত করে বিল্ডিং ফর ফিউচারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীরুল হক প্রবাল বলেন, চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরের বাজেটে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ায় দেশের বাইরে টাকা যাচ্ছে না। তাতে আবাসনে বিনিয়োগ আসছে। ফ্ল্যাট বিক্রি বৃদ্ধির পেছনে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগটি বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন তিনি।

ফ্ল্যাট কেনার জন্য ক্রেতাদের মধ্যে অনেক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে জমির মালিকেরাও নতুন চুক্তিতে আসতে শুরু করেছেন।
তানভীর আহমেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শেল্‌টেক্‌
বিল্ডিং ফর ফিউচার ছাড়াও কনকর্ড, র‌্যাংগস প্রোপার্টিজ, শেল্টেক্, নাভানা রিয়েল এস্টেট, শামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেট, অ্যাসেট ডেভেলপমেন্টস, বেঙ্গল ওয়ান ক্রিয়েশনসহ কয়েকটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, ফ্ল্যাটের বিক্রি বেড়েছে। নতুন ক্রেতাদের খোঁজখবর নেওয়ার হারও বেশ আশাব্যঞ্জক।

দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক সময়ে ৪০-৫০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। করোনার কারণে মার্চ-এপ্রিলে ব্যবসা খারাপ গেলেও গত মাসে ৪২ কোটি টাকার ফ্ল্যাট বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রস্তুত ও নির্মাণাধীন সব প্রকল্পের ফ্ল্যাটই বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানটির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১২ সালে আবাসন খাতে মন্দা শুরু হয়। পরের বছর টানা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেটি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সে সময় ফ্ল্যাটের মূল্য কমিয়েও ক্রেতা খুঁজে পায়নি অনেক প্রতিষ্ঠান। কিস্তি দিতে না পারায় অনেক ফ্ল্যাটের ক্রেতা বুকিং বাতিলও করেছেন। সেই অস্থির সময় পার করে ২০১৬ সালের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হলেও সংকট কাটেনি। তবে ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে সরকারি কর্মচারীদের ৫ শতাংশ সুদে গৃহঋণ দেওয়ার ঘোষণা আসে। আবার গত বছর নিবন্ধন ব্যয় কমানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়। ফলে করোনার আগপর্যন্ত আবাসন ব্যবসা ইতিবাচক ধারায় ছিল।

জানতে চাইলে আবাসন খাতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান শেল্টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, লকডাউন তুলে দেওয়া পর সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। মানুষের মধ্যে ভয়ভীতিও কিছুটা কমেছে। ফলে ফ্ল্যাট কেনার জন্য ক্রেতাদের মধ্যে অনেক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে জমির মালিকেরাও নতুন চুক্তিতে আসতে শুরু করেছেন। বর্তমানে শেল্টেকের ২৫-২৬টি নতুন প্রকল্প পাইপলাইনে রয়েছে।

স্বল্প জায়গায় কীভাবে বেশি মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, সেই চিন্তা থেকেই দেশে আবাসন ব্যবসার গোড়াপত্তন হয়। শুরু করেছিলেন ইস্টার্ন হাউজিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম। তাঁর দেখানো পথ ধরেই ধীরে ধীরে অন্যরা আবাসন ব্যবসায় আসেন। বর্তমানে রিহ্যাবের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ২০০। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে গড়ে ১০-১২ হাজার ফ্ল্যাট ক্রেতাদের কাছে হস্তান্তর করে। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান সময়মতো ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেওয়ায় খাতটির প্রতি আস্থাও হারিয়েছেন অনেক ক্রেতা।

বর্তমানে যে পরিমাণ ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে, সেটিকে মন্দের ভালো বলে মন্তব্য করেন র‌্যাংগস প্রোপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশিদ রহমান। তিনি বলেন, করোনা–পরবর্তী সময়ে গ্রাহকেরা ভালো প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকছেন। কারণ, নিজেদের কষ্টের উপার্জন বিনিয়োগ করে অনিশ্চয়তায় মধ্যে থাকতে চান না তাঁরা।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে কোনো রকম প্রশ্ন করার বিধান না রেখে ফ্ল্যাট ও জমি ক্রয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে সরকার। ফলে এখন থেকে ফ্ল্যাট ও জমি কিনলে আয়তনের ওপর নির্দিষ্ট কর দিলেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রশ্ন করবে না। এতে আবাসন ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি অবশেষে পূরণ হলো।

ফ্ল্যাট কিনে কালোটাকা সাদা করতে চাইলে গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল ও দিলকুশার বাণিজ্যিক এলাকায় প্রতি বর্গমিটারে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা এবং ধানমন্ডি, প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের হাউজিং সোসাইটি (ডিওএইচএস), মহাখালী, লালমাটিয়া

হাউজিং সোসাইটি, উত্তরা মডেল টাউন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, কারওয়ান বাজার, বিজয়নগর, নিকুঞ্জ, ওয়ারী, সেগুনবাগিচা এবং চট্টগ্রামের খুলশী, আগ্রাবাদ, নাছিরাবাদে প্রতি বর্গমিটারে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা কর দিতে হবে। এসব এলাকার বাইরে যে কোনো সিটি করপোরেশনে প্রতি বর্গমিটারে ৭০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা কর দিতে হবে।

জানতে চাইলে রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন গত সপ্তাহে বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট বিক্রি বৃদ্ধির তথ্য পাচ্ছি। বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সব মিলিয়ে আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।’

-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top