সেবা ডেস্ক: বাংলাদেশে’র রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদে’র নির্দেশনা মানতে ‘হার্ডলাইনে’ কাজ শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নির্মূলে ইতোমধ্যে কমিশন নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
মেয়াদোত্তীর্ণ এক-চতুর্থাংশ অনুসন্ধান ও তদন্তে’র ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদে’র কোনো গাফিলতি কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এজন্য প্রায় দুই ডজন কর্মকর্তাকে তলব করে কৈফিয়ত নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া কোনো কর্মকর্তা’র বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গে’র প্রমাণ পেলে ‘দুদক (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা ২০০৮’-এ’র ৫৪ ধারায় ব্যবস্থা গ্রহণে’র হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কমিশনে’র ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও অসদাচ’রণে’র অভিযোগে এক কর্মকর্তাকে সাময়িক ব’রখাস্তও করা হয়েছে। এদিকে কমিশনে’র এই অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নির্মূলে’র উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদে’র মতে, যে কোনো কিছু’র ঊর্ধ্বে থেকে কমিশনকে এই অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নির্মূলে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা উচিত। এ
কই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি রোধে গোয়েন্দা তৎপ’রতা বৃদ্ধি’র পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এ’র আগে দুদককে নিজ ঘ’র থেকে অভিযান শুরু’র নির্দেশনা দেওয়া হয়। ৯ ডিসেম্ব’র ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস-২০২১’ উপলক্ষ্যে ভিডিও বার্তায় রাষ্ট্রপতি ওই নির্দেশনা দেন।
জানতে চাইলে দুদক কমিশনা’র (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন সময় যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছেন, সেগুলো আমরা পালন করা’র চেষ্টা ক’রছি। একদিনে সব সমস্যা’র সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা ক’রছি। এক প্রশ্নে’র জবাবে তিনি বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নির্মূলে’র কথা বলেছেন। আমরা অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নির্মূলে’র ক্ষেত্রে আইনে যতটুকু সাপোর্ট করে, ততটুকু মেনে কাজ ক’রছি। একদিনে সব হয়ে যাবে-সেই প্রত্যাশাও করি না। তবে আমাদে’র ইচ্ছা আছে। আমরা সে অনুসারে উদ্যোগও নিচ্ছি। আশা ক’রছি, ভালো ফল পাব।
দুদকে’র সাবেক চেয়া’রম্যান গোলাম ‘রহমান বলেন, দুদকে যারা কাজ করে, তারা সমাজে’রই লোক। সমাজে যেমন ভালো-মন্দ আছে, দুদকেও তেমন ভালো-মন্দ ‘রয়েছে। সমাজকে পরিশুদ্ধ করা’র জন্য দুদক কর্মকর্তাদে’র দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই দুদক কর্মকর্তাদে’র নিজেদে’র পরিশুদ্ধ রাখতে হবে।
তিনি বলেন, প্রশাসনিকভাবে অনেকে’র শাস্তিও হয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিককালে একজন পরিচালক দুর্নীতি’র দায়ে জেলেও গেছেন। দুদক যে কার্যক্রম শুরু করেছে, এটা অত্যন্ত ভালো কাজ। এটাকে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি। তবে এ কাজকে আ’রও বেগবান ক’রতে কমিশনকে নিজস্ব সোর্সে’র মাধ্যমে কর্মকর্তাদে’র ওপ’র একধ’রনে’র গোয়েন্দাগিরি ক’রতে হবে।
দুদক সচিব ড. মু. আনোয়া’র হোসেন হাওলাদা’র বুধবা’র সাংবাদিকদে’র বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো নিয়ে কমিশনে’র ত্রৈমাসিক সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি’র নির্দেশনা বাস্তবায়নে কমিশন কাজ করে চলেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টা’রন্যাশনাল বাংলাদেশে’র (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্রপতি অত্যন্ত সুন্দ’র নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। দুদকে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি চলে। অনেক সময় দুদক নিজেও তা প্রকাশ্যে না হলে গোপনে স্বীকা’র করেছে। এ শাস্তি যেন শুধু বদলি কিংবা বিভাগীয় ব্যবস্থা’র মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। স’রকারি কর্মকর্তা হলেও আইনে’র চোখে সবাই অপরাধী। দুর্নীতিবাজদে’র চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’র আওতায় ও জবাবদিহিতায় আনতে পা’রলে রাষ্ট্রপতি’র নির্দেশনা অনুসারে কমিশনে’র এ উদ্যোগে’র সুফল পাওয়া যাবে।
দুদকে’র প্রতি রাষ্ট্রপতি’র নির্দেশনা : ৯ ডিসেম্ব’র আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনাসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে ভিডিও বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, একজন দুর্নীতিবাজে’র পরিচয় শুধুই দুর্নীতিবাজ। যে দলে’রই হোক, তাকে আইনে’র আওতায় আনতে হবে। দুদককে দুর্নীতি দমনে আ’রও দৃঢ়তা’র সঙ্গে দায়িত্ব পালন ক’রতে হবে। আমি আশা ক’রব, আপনারা নিজেদে’র ঘ’র থেকে অভিযান শুরু ক’রবেন। কিছুসংখ্যক লোকে’র জন্য যাতে পুরো কমিশনে’র ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি কমিশনে’র সব কর্মকর্তা’র প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে তারা যেন সর্বোচ্চ নি’রপেক্ষতা ও নৈতিকতা প্রদর্শন করেন। অন্যে’র দুর্নীতি চিহ্নিত করে বিচারে’র আওতায় আনা’র আগে নিজেদে’র অনিয়ম ও অসততা দূ’র ক’রতে হবে। যারা রাষ্ট্রে’র অর্পিত দায়িত্ব ও ক্ষমতা’র অপব্যবহা’র ক’রবে, তাদে’র কঠো’রভাবে নিয়ন্ত্রণ করে বিচারে’র আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতি ক’রলে শাস্তি পেতে হবে এবং দুর্নীতি করে কেউ পা’র পাবে না-জনমনে এমন ধা’রণা জন্মাতে পা’রলেই দুদকে’র ওপ’র জনগণে’র আস্থা বাড়বে। সামাজিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব জাগ্রত না হলে শুধু দুর্নীতি দমন কমিশনে’র একা’র পক্ষে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়। আইনে’র শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি’র বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলা’র বিকল্প নেই।
শৃঙ্খলা ভঙ্গে ৫৪ ধারায় ব্যবস্থা’র হুঁশিয়ারি : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে দুদকে’র এক-চতুর্থাংশ অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমই মেয়াদোত্তীর্ণ। বিদ্যমান আইনে’র নির্ধারিত সময়ে’র মধ্যে ২৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ অনুসন্ধান এবং ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ মামলা’র তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি। মেয়াদোত্তীর্ণ মোট অনুসন্ধান ও মামলা’র তদন্তে’র হা’র ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। চলতি বছরে’র ৩১ অক্টোব’র পর্যন্ত দুদকে’র মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ১১১৯টি এবং মেয়াদোত্তীর্ণ তদন্ত ২০৩টি। এসব অনুসন্ধান ও তদন্তে’র মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া’র কা’রণ সম্পর্কে জানতে সম্প্রতি প্রায় দুই ডজন কর্মকর্তাকে তলব করে কা’রণ জানতে চেয়েছে কমিশন।
জিজ্ঞাসাবাদে’র একপর্যায়ে যদি কোনো কর্মকর্তা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন তবে তা’র বিরুদ্ধে দুদক (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা ২০০৮-এ’র ৫৪ ধারা অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণে’র হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। ৫৪ ধারায় চাকরি’র অবসানে’র কথা বলা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়, ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ (কমিশন) কোনো কা’রণ প্রদর্শন না করে এবং এক মাসে’র নোটিশ দিয়ে অথবা ওই নোটিশে’র পরিবর্তে এক মাসে’র বেতন দিয়ে কোনো শিক্ষানবিশে’র চাকরি’র অবসান ঘটাতে পা’রবে এবং শিক্ষানবিশ তা’র চাকরি অবসানে’র কা’রণে কোনো ক্ষতিপূ’রণ পাবে না।’ মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও তদন্তে’র পাশাপাশি কর্মকর্তাদে’র বিরুদ্ধে আসা যে কোনো অভিযোগই গুরুত্বে’র সঙ্গে আমলে নিচ্ছে কমিশন।
কর্মকর্তাদে’র মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া : রাষ্ট্রপতি’র নির্দেশনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন দুদকে’র প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। তবে কমিশনে’র এই ৫৪ ধারা ব্যবহারে’র হুমকিতে কর্মকর্তাদে’র মধ্যে একধ’রনে’র মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। একাধিক কর্মকর্তা’র মতে, কাজ ক’রলে ভুল হতে পারে। কাজ না ক’রলে ভুল হওয়া’র কোনো সুযোগ নেই। দুদক (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা ২০০৮-এ’র ৫৪ ধারা অনুস’রণ করা’র ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা’র শঙ্কা ‘রয়েছে।
তবে বিধিমালা’র ৩৮ ধারা অনুস’রণে কোনো বাধা নেই। সেখানে ‘আচ’রণ ও শৃঙ্খলা’র’ কথা বলা হয়েছে। আ’র ৪০ ধারায় ‘লঘু ও গুরুদণ্ডে’র’ কথা বলা আছে। সে অনুসারে শৃঙ্খলাভঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীদে’র ওপ’র ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে যৌক্তিক। ৫৪ ধারা অনুস’রণে একজন কর্মকর্তা তা’র সাংবিধানিক অধিকা’র থেকে বঞ্চিত হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দেওয়া’র সুযোগটুকুও পাওয়া যায় না। ফলে রাষ্ট্রপতি’র বক্তব্যে’র প’র কমিশনে’র কর্মকর্তাদে’র মধ্যে এক ধ’রনে’র চাপা আতঙ্ক কাজ ক’রছে। এজন্য কাজ না করে একধ’রনে’র ‘হাত-পা গুটিয়ে’ রেখেছেন তারা।
উপপরিচালক ব’রখাস্ত : কমিশনে’র ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও অসদাচ’রণে’র অভিযোগে সম্প্রতি দুদকে’র উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিনকে সাময়িক ব’রখাস্ত করা হয়েছে। দুদকে’র চেয়া’রম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ১৫ ডিসেম্ব’র এ বিষয়ে একটি অফিস আদেশ জারি করেন। আদেশে বলা হয়, মো. সালাহউদ্দিনে’র বিরুদ্ধে তা’র স্ত্রী’র নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এবং পেনাল কোডে’র ৩২৩ ধারায় যৌতুকে’র টাকা’র জন্য মা’রধ’র ও জখমে’র অভিযোগ করেছেন।
তিনি ফৌজদারি অপরাধে’র এ মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালত থেকে জামিন পেলেও বিষয়টি কমিশনকে অবহিত না করে গোপন রাখেন। যেহেতু উপরিউক্ত কার্যকলাপে দুর্নীতি দমন কমিশনে’র ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাই কমিশনে’র (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮-এ’র ৩৯(খ) অনুযায়ী, অসদাচ’রণে’র আওতায় অবিলম্বে তাকে চাকরি থেকে সাময়িক ব’রখাস্ত করা যুক্তিযুক্ত ও অপরিহার্য। সেহেতু কমিশনে’র চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, মো. সালাহউদ্দিনকে সাময়িক ব’রখাস্ত করা হলো।
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।