সেবা ডেস্ক: কৃষক বা কৃষি’র সাথে জড়িত ব্যক্তি নিজেই ক’রতে পা’রবেন তা’র জমি’র মাটি পরীক্ষা। মাত্র পাঁচ মিনিটেই জানতে পা’রবেন তা’র জমি’র মাটি’র গুণাগুণ।
একটা ডিভাইস নিয়ে মাঠে যাবেন কৃষক। যাওয়া’র প’র এই ডিভাইসটি’র সেন্স’র দিয়ে মাটি’র আর্দ্রতা, পিএইচ, নাইট্রোজেন ফসফরাস, পটাশিয়াম- এগুলো পরিমাপ ক’রবেন। পরিমাপে’র প’র যে ফল আসবে (মাটি’র আর্দ্রতা ১০ শতাংশ, পিএইচ ৭ বা অন্যগুলো’র তথ্য) সেগুলো মোবাইল অ্যাপে’র মধ্যে দেয়া হবে। এ’রপ’র মোবাইল অ্যাপ তাৎক্ষণিক ক্যালকুলেট করে জানিয়ে দেবে মাটি’র সার্বিক অবস্থা। যেমন: মাটিতে সারে’র পরিমাণ কম আছে নাকি বেশি, কোন ধ’রনে’র সা’র কী পরিমাণ দ’রকা’র হবে এবং কোন ধ’রনে’র ফসল ভালো হতে পারে, সেই পরামর্শ আসবে তাৎক্ষণিকভাবে। মাটিতে যদি পিএইচে’র পরিমাণ বেশি থাকে কিভাবে কমাতে হবে, কী সা’র দিতে হবে; নাইট্রোজেনে’র পরিমাণ কম থাকলে কিভাবে বাড়াতে হবে, বেশি থাকলে কিভাবে কমাতে হবে- সবকিছুই ক্যালকুলেট করে নির্ণয় করা যাবে একটি যন্ত্রে’র মাধ্যমে।
এই মাটি পরীক্ষা’র ডিভাইস
বা যন্ত্র আবিষ্কা’র করেছেন তিন তরুণ। যারা
সবাই ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে’র
সাবেক শিক্ষার্থী। আব্দুল্লাহ আল আরাফ, রাহাত
উদ্দিন এবং রেজাউল খান
নামে’র এই তিন বন্ধু’র
আবিষ্কা’রটি’র নাম দিয়েছেন ‘মাটি’র
প্রাণ’। কৃষিবান্ধব ডিজিটাল
পোর্টেবল সয়েল টেস্টিং ডিভাইস
(মাটি পরীক্ষা’র যন্ত্র) এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে
আছে। বর্তমানে তারা তথ্য ও
প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে’র অনুদানে একটি প্রকল্পে’র আওতায়
গবেষণাটি এগিয়ে নিচ্ছেন। এটিকে কৃষক বা ভোক্তাপর্যায়ে
নিতে আরো চয়-সাত
মাস সময় লাগবে বলে
জানিয়েছেন তিন তরুণে’র অন্যতম
আব্দুল্লাহ আল আরাফ।তিনি জানান,
প্রথমে এই ধ’রনে’র আইডিয়া
আমা’র মাথা থেকেই আসে।
আমি বন্ধুদে’র সাথে শেয়া’র করি।
আমা’র এই আইডিয়া’র সাথে
রাহাত ও রেজাউল একাত্মতা
প্রকাশ করেন। এ’রপ’র আমরা এ নিয়ে
কাজ শুরু করি।
গবেষকরা
বলছেন, আমাদে’র দেশে’র কৃষি খাত প্রযুক্তি’র
দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে
আছে। তাই আমরা আমাদে’র
ডিপ্লোমা’র শেষে’র দিকে গ্রামে চলে
যাই। আমাদে’র এলাকা’র যারা কৃষিকাজে’র সাথে
যুক্ত তাদে’র সাথে অনেক দিন
কাটাই। তাদে’র সাথে কথা বলি,
তাদে’র সমস্যাগুলো বোঝা’র চেষ্টা করি। শেষে দেখতে
পাই যে, তারা বেশি’র
ভাগ সময় শুধু ধা’রণা’র
ওপ’র ভিত্তি করেই জমি চাষ,
পানি দেয়া, সা’র দেয়াÑ এগুলো
করে আসছেন। যা’র ফলে বিভিন্ন
সময় তারা তাদে’র কাক্সিক্ষত
ফলন পাচ্ছেন না। তাদে’র এসব
কিছু অ্যানালাইসিস করে আমরা বুঝতে
পারি যে, এই সমস্যা
সমাধানে’র একমাত্র উপায় হচ্ছে, মাটি
পরীক্ষা করে তা’রপ’র চাষে’র
সিদ্ধান্ত নেয়া; কিন্তু আমাদে’র দেশে’র বেশি’র ভাগ কৃষক গ্রামে
বাস করে। বছরে’র প’র
বছ’র ধরে তারা তাদে’র
গতানুগতিকভাবে ফসল চাষ করে
যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাই
যে, আমাদে’র বেশি’র ভাগ কৃষকই মাটি
পরীক্ষা’র বিষয়ে আগ্রহী নয়। এ’র কা’রণ
হচ্ছে বর্তমানে ফসলে’র মাঠে’র মাটি পরীক্ষা’র জন্য
যে পদ্ধতি মানা হয় তাতে
অনেক ঝক্কিঝামেলা ‘রয়েছে। কৃষককে মাঠ থেকে মাটি’র
নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে নিয়ে
যেতে হয়। এ’রপ’র একটি
নির্দিষ্ট ফি’’র বিনিময়ে
তা’র নমুনা মাটিটুকু দিয়ে আসেন পরীক্ষা’র
জন্য। পরীক্ষা’র ফলাফল আসতে সময় লাগে
২৫-৩০ দিন। এই
মাটি পরীক্ষা’র সহজ উপায় যদি
কৃষকে’র হাতে’র কাছে পৌঁছানো যায়
তাহলে কৃষক এই মাটি
পরীক্ষা’র প্রতি আগ্রহী হবেন।
তিন
তরুণ গবেষকে’র মধ্যে আব্দুল্লাহ আল আরাফে’র বাড়ি
নোয়াখালী’র মাইজদীতে। ঢাকা পলিটেকনিক থেকে
কম্পিউটা’র টেকনোলজি বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং
পাস করেন ২০১৮ সালে।
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিতে সিএসসি ডিপার্টমেন্ট থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন
করেন। রাহাত উদ্দিনে’র বাড়ি চাঁদপুরে’র মতলব
উত্তরে’র। গ্রামে’র ইমামপু’র পল্লী মঙ্গল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে
মাধ্যমিক শেষ করেন। এ’রপ’র
ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ইলেকট্র্রনিকস টেকনোলজি বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ইন
ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন ২০১৮
সালে। বর্তমানে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্র্রনিকস ডিপার্টমেন্ট থেকে গ্র্যাজুয়েশন ক’রছেন।
আরেক গবেষক রেজাউল খানে’র বাড়ি গাজীপুরে। তিনিও
ঢাকা পলিটেকনিকে কম্পিউটা’র টেকনোলজি বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ইন
ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন ২০১৮
সালে। বর্তমানে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিতে সিএসসি ডিপার্টমেন্ট থেকে গ্র্যাজুয়েশন ক’রছেন।
আব্দুল্লাহ
আল আরাফ জানান, আমরা
তিন বন্ধু মিলে মাটি গবেষণা’র
আইডিয়াকে বাস্তবে রূপ দেয়া’র জন্য
২০১৮ সালে’র মাঝামাঝিতে কাজ শুরু করি।
শুরুতেই আমরা কী কী
দিক নিয়ে কাজ ক’রব
তা ঠিক করি। আমরা
আমাদে’র প্রজেক্টে’র নাম দেই ‘মাটি’র
প্রাণ’। এই প্রজেক্টটি
হচ্ছে কৃষিবান্ধব ডিজিটাল পোর্টেবল সয়েল টেস্টিং ডিভাইস।
এটি বেশ কিছু সেন্সরে’র
সমন্বয়ে গঠিত, যা’র সাথে একটি
মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন আছে। কৃষক তা’র
ফসলে’র মাঠে বসেই মাটি
পরীক্ষা করে ফসলে’র মাঠে’র
অবস্থা সম্পর্কে জানতে পা’রবেন এই ডিভাইসে’র মাধ্যমে।
কৃষক ডিভাইসটি নিয়ে মাঠে যাবেন
এবং জমিতে ৯টি ব্লকে চিহ্নিত
করে মাটি’র নমুনা সংগ্রহ ক’রবেন। সংগৃহীত নমুনা মাটি থেকে দ্রবণ
(মিশ্রণ) তৈরি ক’রবেন এবং
সেই দ্রবণে পিএইচ সেন্সরে’র মাধ্যমে মাটি’র মান নেবেন। আর্দ্রতা
পরিমাপক সেন্স’রকে মাঠে’র মাঝামাঝি স্থাপন করে মাটি’র আর্দ্রতা’র
মান নেবেন। এ’রপ’র মাটি’র নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম পরিমাপ
ক’রবেন। মাটি থেকে প্রাপ্ত
তথ্যগুলো আমাদে’র মাটি’র প্রাণ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে ইনপুট দেবেন। মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি সম্পূর্ণ বাংলায় তৈরি করা। ফলে
একজন কৃষক খুব সহজেই
এটি ব্যবহা’র ক’রতে পা’রবেন। অ্যাপ ইনপুটকৃত তথ্যগুলোকে বিশ্লেষণ করে মাটি’র বর্তমান
অবস্থা, পুষ্টি উপাদান, কী পরিমাণ সা’র
দিতে হবে এবং ওই
মাটিতে কী ফসল ভালো
হবে তা বলে দেবে।
আব্দুল্লাহ
বলেন, আমাদে’র এই ‘মাটি’র প্রাণ’
অ্যাপ্লিকেশনে কৃষকদে’র জন্য বেশ কিছু
সুবিধা ‘রয়েছে, যা’র মধ্যে উল্লেখযোগ্য
হচ্ছে- কৃষকে’র স্বাস্থ্য। আমাদে’র কৃষকরা বিভিন্ন সময় মাঠে অনেক
দুর্ঘটনা’র সম্মুখীন হন। তখন তারা
বুঝে উঠতে পারেন না
যে, কী ক’রবেন। আমাদে’র
মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে সেসব প্রাথমিক চিকিৎসাগুলো
সম্পর্কে জানতে পা’রবেন। এ ছাড়াও তারা
মাঠে কীটনাশক প্রয়োগ সম্পর্কে, কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সা’র দেবেন
সে বিষয়ে সব নির্দেশনাবলি পাবেন।
কৃষকরা যাতে তাদে’র অঞ্চলে’র
কৃষি কর্মকর্তাদে’র সাথে যোগাযোগ এবং
তা’র সমস্যাগুলো দ্রুত পৌঁছাতে পারেন সে ব্যবস্থাও আছে।
কৃষি কর্মকর্তা ও আমাদে’র এই
অ্যাপ্লিকেশনে’র মাধ্যমে তা’র অঞ্চলে’র রেজিস্টার্ড
কৃষকদে’র ফসলে’র অবস্থা, কী কী চাষাবাদ
হচ্ছে সব তথ্য পাবেন
এবং কৃষকদে’র দ্রুত তথ্য স’রবরাহ ক’রতে
পা’রবেন।
রাহাত
উদ্দিন জানান, আমাদে’র এই ডিভাইসটি চাঁদপু’র
ও কুমিল্লায় কৃষকদে’র মধ্যে পাইলটিং পর্যায়ে ‘রয়েছে। আমাদে’র ইচ্ছা এটিকে সারা দেশে’র কৃষকদে’র
মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। তথ্য ও প্রযুক্তি
মন্ত্রণালয় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে
আমাদে’র ছয় লাখ টাকা
অনুদান দিয়েছে। আমরা আশা ক’রছি,
আগামী ছয় মাসে’র মধ্যে
ভোক্তা বা কৃষকপর্যায়ে ব্যবহারে’র
উপযোগী হিসেবে তৈরি ক’রতে সক্ষম
হবো। আরেক গবেষক রেজাউল
খান বলেন, ডিভাইসটি কৃষকে’র হাতে যতটা স্বল্প
মূল্যে সহজলভ্যভাবে তুলে দেয়া যায়
সেভাবেই আমরা চিন্তা ক’রছি।
এই তিন তরুণ গবেষক
জানান, শুরু’র দিকে নিজেদে’র খ’রচে
তারা এক বছ’র গবেষণাকাজ
চালিয়ে যান। এই ধ’রনে’র
গবেষণাকাজে’র জন্য একটা ভালো
ল্যাবে’র প্রয়োজন ছিল। আবা’র প্রজেক্টে’র
বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দেশে’র বাইরে থেকে আমদানি করা’র
বিষয় ছিল। ইনস্টিটিউশন অব
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়া’রস, বাংলাদেশ (আইডিইবি’’র) সভাপতি এ
কে এম এ হামিদ
তাদে’র আইডিইবিতে গবেষণা’র জন্য একটি আইওটি
অ্যান্ড রোবটিক্স রিসার্চ ল্যাব স্থাপন করে দেন। তারা
আরো জানান, আমরা পুরোদমে গবেষণা
চালিয়ে যাই। আমাদে’র এই
‘মাটি’র প্রাণ’ প্রজেক্ট নিয়ে থাইল্যান্ড শিক্ষা
মন্ত্রণালয়ে’র আমন্ত্রণে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে
অংশগ্রহণ করি। সেখানে সাতটি
দেশে’র মধ্যে দ্বিতীয় হওয়া’র গৌ’রব অর্জন করে ‘মাটি’র প্রাণ’। এ’রপ’র সেখান
থেকে ফিরে ‘ব্যাসিস ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ডে’ অংশ নিয়ে সিনিয়’র
স্টুডেন্ট ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হন তারা। ২০১৯
সালে ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত এপিক্টা অ্যাওয়ার্ডে অংশ নেন। এই
প্রজেক্টকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া’র জন্য
আরাফ, রাহাত ও রেজাউল তথ্য
ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে’র বিশেষ অনুদানে’র জন্য আবেদন করেন।
তাদে’র এই আইডিয়াটা পছন্দ
করে ছয় লাখ টাকা
অনুদান দেয় তথ্য ও
প্রযক্তি মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্পে তাদে’র
মেন্ট’র হিসেবে আছেন ইউনাইটেড ইন্টা’রন্যাশনাল
ইউনিভার্সিটি প্রফেস’র ড. খন্দকা’র আব্দুল্লাহ
আল মামুন।
ডিভাইসটি বানাতে আট হাজা’র টাকা খ’রচ পড়েছে উল্লেখ করে আব্দুল্লাহ আল আরাফ জানান, ‘মাটি’র প্রাণ’ ডিভাইসটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস কর্তৃৃক রেজিস্টার্ড হয়েছে। এখন শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে প্যাটার্ন নিতে আবেদন প্রক্রিয়াধীন। এ’রপ’র চূড়ান্তভাবে তথ্য ও প্রযক্তি মন্ত্রণালয়ে’র কাছে প্রেজেন্টেশন করা হবে। যেহেতু কৃষি বা কৃষকদে’র সুবিধা’র জন্যই এই আবিষ্কা’র তাই এখন আমাদে’র কৃষি মন্ত্রণালয়ে’র অনুমোদন দ’রকা’র। আমরা চাই স’রকা’র যেন কৃষকে’র মধ্যে আমাদে’র এই প্রযুক্তিটি ছড়িয়ে দেয়া’র ব্যবস্থা করে। স’রকারে’র পাশাপাশি আমরা প্রাইভেট পর্যায়ে’র প্রতিষ্ঠানগুলোও এ বিষয়ে এগিয়ে আসা’র আহ্বান ক’রছি।
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।