ঘুরে আসুন ঐতিহাসিক মালেকা বানুর দেশে

S M Ashraful Azom
1

 : ইতিহাস ও ঐতিহ্য হলো অতীতের সাথে বর্তমানের সেতুবন্ধন। পূর্বেকার কৃষ্টিকালচার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে বর্তমানের সংযোগ সাঁকোতেই আমরা জানতে পারি অনেক কিছু। সমৃদ্ধ ইতিহাস আমাদের কাছে অনুপ্রেরণা ও পূর্বপুরুষ সম্পর্কে জানতে প্রেরণা দেয়। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার মালেকা বানু চৌধুরী চট্টগ্রামের লোকসাহিত্যে অন্যতম উপাখ্যান।

ঘুরে আসুন ঐতিহাসিক মালেকা বানুর দেশে
মালেকা বানু চৌধুরী'র স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক 'মালেকা বানু মসজিদ, কবর ও লেখক।।- ছবি শিব্বির আহমেদ রানা



নীরেট প্রেমের কাহিনীর অন্যতম একটি 'মালেকা বানু-মনুমিয়ার প্রেম। যাকে ঘিরে রচিত হয়েছে লোকসাহিত্যে সমৃদ্ধ ইতিহাস। যেমন- 'মালেকা বানুর দেশেরে, বিয়ার বাইদ্য অলা বাজেরে। মালেকা বানুর সাতও ভাই, অভাইগ্যা মনু মিয়ার কেহ নাই।/ মালেকা বানুর বিয়া হইবো, মনু মিয়ার সাথেরে।' সে সময়ের এমন একটি জনপ্রিয় আমাদের পূর্ব বাংলার সমৃদ্ধ লোকসাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে মালেকাবানু ও মনুমিয়ার প্রেমের উপাখ্যান হিসেবে। 

এই প্রেমকাহিনী তখন সারাদেশময় আলোড়ন তুলেছিলো। তাদের প্রেম উপাখ্যান কোনো রূপকথার গল্প নয়, কোন মাধুরি মাখা লেখকের কাল্পনিক গল্প নয়। মালেকা বানু-মনু মিয়ার প্রেম উপাখ্যান ছিল নীরেট ও বাস্তবভিত্তিক এক প্রেম কাহিনী। লোককথার সেই মালেকা বানু ও মনুমিয়ার গল্প ও যাত্রাপালার সাথে আমাদের আজকের প্রজন্মের পরিচিতি নাও থাকতে পারে। 

কিন্তু বাংলাদেশের মূল শিকড় এবং একেবারে নিজস্ব গৌরবের বিষয় হলো আমাদের লোক সাহিত্য। কারণ এমন সমৃদ্ধ, জীবনমূখী ও পুরনো লোকসাহিত্য পৃথিবীর কোনো জাতির নেই।সেই আমাদের লোকসাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে মালেকাবানু ও মনুমিয়ার প্রেমের উপাখ্যানে।

স্থানীয় মুরব্বী ও লোকশ্রæতি থেকে শুনা এই প্রেমকাহিনী তখন সারাদেশময় আলোড়ন তুলেছিলো। চট্টগ্রামের মালেকা বানু-মনু মিয়ার প্রেম উপাখ্যান ইতিপূর্বে লোকগাথা, যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক ও পূর্নদৈর্ঘ্য বাংলা চলচিত্রেও নির্মিত হয়েছে। তাদের প্রেম উপাখ্যান কোনো রূপকথার গল্প নয়, নয় কোন কাল্পনিক কেচ্ছা।  মালেকা বানু-মনু মিয়ার প্রেম উপাখ্যান ছিল বাস্তবভিত্তিক প্রেম কাহিনী। জনশ্রুতি আছে মালেকা বানু ও মনুমিয়ার বিয়ে হয়েছিলো খুব ঝাঁকজমকপূর্ণভাবে এবং ঐতিহাসিকভাবে। জানা যায়, একমাস ধরে চলেছিলো তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান যজ্ঞ। আর সেই বিয়েতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিল্পীরা এসে গান পরিবেশন করেছেন। তারমধ্যে এই গানটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। এমনকি এখনো গ্রামে-গঞ্জে গানটি বেশ লোকপ্রিয়। তবে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারাতে বসেছে লোকসাহিত্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস। এখনো গ্রামের মুরব্বীরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে 'সে দিন আর আছে কই, ফিরে আর আসবে কি পুরানো সেদিন? এখন তো পুরানে আগ্রহ নাই! আমাদের সমৃদ্ধ লোকসাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রও নাই।'

বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহাসিক মালেকা বানুর দিঘী এখন লবণ মাঠ ও মাছের ঘের
বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহাসিক মালেকা বানুর দিঘী এখন লবণ মাঠ ও মাছের ঘের।।- ছবি শিব্বির আহমেদ রানা

ঐতিহাসিক মনুমিয়া-মালেকা বানুর নায়িকা চরিত্রে মালেকাবানু চৌধুরীর জন্মস্থান চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সরল ইউনিয়নে। বর্তমানে মালেকাবানু-মনুমিয়ার প্রেম উপাখ্যানের কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সরল ইউনিয়েনে অবস্থিত মালেকা বানু চৌধুরীর মসজিদটি। কথিত থাকে যে, এখানে বিশাল একটা দিঘী ছিলো এককালে। কিন্তু কালের আবর্তে দিঘীটা আজ আর নেই। পুরো দিঘীটাই এখন লবণের মাঠ ও মাছের ঘের হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এক চোখের পথ ছিল এই মালেকাবানুর দিঘীটা। বিশাল দিঘীর সে চিত্র এখন লবণমাঠে ও মৎস্য ঘের। দীঘির পশ্চিম পাশে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে মালেকাবানুর মসজিদটিই এখন স্মৃতির স্বাক্ষর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের দেওয়ালের উত্তর পাশে খোদাইকৃত একটি ফলকে মালেকাবানু চৌধুরী মসজিদের সংক্ষিপ্ত লিপিবদ্ধ ছিল- 'মোগল শাসনামলের শেষ দিকে জমিদার আমির মোহাম্মদ চৌধুরী এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিনি ছিলেন ঐতিহ্যবাহী মালেকা বানু চৌধুরীর পিতা। মালেকা বানু চৌধুরীর ছোট ভাইয়ের বংশধর মরহুম ফৌজুল কবির চৌধুরী। ১৩৮৪ বাংলা এবং ইংরেজী ১৯৭৮ সালে মসজিদটি প্রথম সংস্কার করেন। সর্বশেষ চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ ঐতিহ্যসংরক্ষণ ও এর শ্রী-বৃদ্ধি করণে বাংলা ১৪১৭ এবং ইংরেজী ২০১০ সালে মসজিদটিতে টালি সংযোজন, সংস্কার ও ফলক স্থাপন করেন। পরবর্তীতে বাংলা ১৪২৮ এবং ইংরেজী ২০২১ সালে মরহুম ফৌজুল কবির চৌধুরীর পুত্রগণ মূল মসজিদের পুনঃ সংস্কার করে একতলা বিশিষ্ট এর বর্ধিতাংশ নির্মাণ করেন। বর্তমানে মরহুম ফৌজুল কবির চৌধুরীর বংশধরগণ মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করছেন।'

ঐতিহাসিক মালেকা বানু চৌধুরীর কবর জেয়ারত ও মসজিদ পরিদর্শন শেষে কথা হয় মালেকা বানু চৌধুরীর ভাই দেওয়াল আলী চৌধুরীর সর্বকনিষ্ট বংশধর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিদারুল কবির চৌধুরীর সাথে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, 'ইতিহাস থেকে জানা যায়, মালেকা বানু চৌধুরীর পিতা আমির মোহাম্মদ চৌধুরী  ছিলেন তৎকালের প্রভাবশালী জমিদার। তার আট সন্তানের মধ্যে একমাত্র কন্যাসন্তান মালেকা বানু চৌধুরী। তার বাবার জিবদ্দশায় মালেকা বানু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন চট্টগ্রামের আনোয়ারার আরেক জমিদার পুত্র মনু মিয়ার সাথে। তাদের এই বিবাহের পূর্বে মিলন-বিরহের ঘনঘটাপূর্ণ কাহিনী ছিলো। মালেকা বানুর সাত ভাই আর মনুমিয়ার গল্প সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে যাত্রাপালার মাধ্যমে। এক পর্যায়ে মালেকা বানু চৌধুরী-মনুমিয়ার প্রেমের ইতিহাস লোককাহিনীর রুপ লাভ করে। মালেকা বানুর স্মৃতি হিসেবে এখন তার নামে মসজিদটিই আছে কালের স্বাক্ষি হয়ে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ ঐতিহ্যসংরক্ষণ ও এর শ্রী-বৃদ্ধি করণে বাংলা ১৪১৭ এবং ইংরেজী ২০১০ সালে মসজিদটিতে টালি সংযোজন, সংস্কার ও ফলক স্থাপন করেন। অনেক কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ভ্রমণপিপাসুরা দেখতে আসেন এ মসজিদটি।'


    মালেকা বানু চৌধুরী-মনুমিয়ার ঐহিহাসিক প্রেম: 

    মসজিদ সংলগ্ন মালেকা বানুর কবরস্থান
    মসজিদ সংলগ্ন মালেকা বানুর কবরস্থান।।- ছবি: শিব্বির আহমেদ রানা

    ইতিহাসের রজকিনী-চন্ডিদাশ, শিরিন-ফারহাদ এদের প্রেমকাহিনী সম্পর্কে আমাদের প্রজন্মের অজানা নয়। ঐতিহাসিক প্রেমের আরেক নিদর্শন মালেকা বানু- মনুমিয়ার প্রেমকাহিনী। মনুমিয়া জমিদার বংশের পুত্র হলেও মালেকা বানু ছিলেন বাঁশখালী থানার সরল ইউনিয়নের সরল গ্রামের বিখ্যাত এক সওদাগর আমির মোহাম্মদ এর কন্যা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মালেকা বানুর পিতা আমির মোহাম্মদ চৌধুরীর আট সন্তানের মধ্যে একমাত্র কন্যা মালেকা বানু চৌধুরী। মনুমিয়া একদিন পাইক পেয়াদা সঙ্গে নিয়ে জমিদারি তদারকিতে বাঁশখালীর সরল গ্রামের সওদাগর বাড়িতে পৌঁছে সেখানে সাময়িক বিশ্রাম নেন। এ সময় মনুমিয়ার নজরে পড়ে সু-নয়না অপূর্ব সুন্দরী সওদাগর কন্যা মালেকা বানুকে। মালেকা বানু তখন কাজির মক্তবে অধ্যয়নরত। ওখানেই মনুমিয়া এবং মালকা বানুর আঁখির মিলন ঘটে। তখন থেকেই মালেকা বানুর প্রেমে পড়েন মনুমিয়া। এরপর প্রেমের টানে মনু মিয়া বারবার ছুটে যেতেন মালেকা বানুর বাড়িতে। অবশেষে কাজির মাধ্যমে মালেকার বাবার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন মনু মিয়া। মালেকার বাবা সওদাগর রাজি হলেও বিয়েতে মালেকা রাজি ছিলেন না। কারণ হিসেবে মালেকা মনুকে বলেছিলেন- 'সাম্পানযোগে নদী পার হতে তার ভয় করে। কারণ শঙ্খ নদীর এপারে মনুমিয়ার বাড়ি ওপারে মালেকার। কাজেই বধূ সেজে মনুমিয়ার বাড়ি যেতে হলে উত্তাল শঙ্খনদী পাড়ি দিতে হবে। মালেকার মুখে এ কথা শুনে মনুমিয়া স্থির করলেন শঙ্খের বুকে বাঁধ নির্মাণ করবেন। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। মনু মিয়া শঙ্খ নদীর বুকে নির্মাণ করলেন বিশাল এক বাঁধ। তারপর বধূ সাজিয়ে সড়কপথে মনুর রাজপ্রাসাদে এনে তুললেন প্রিয়তমা মালেকা কে। জনশ্রæতি আছে মালেকা বানু ও মনুমিয়ার বিয়ে হয়েছিলো খুব ঝাঁকজমকপূর্ণভাবে। একমাস ধরে চলেছিলো তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান যজ্ঞ। বিয়ের পর তাদের সংসারে এক কন্যা সন্তানের জম্ম হয়। সংসার জীবনে একপর্যায়ে মালেকা বানু স্বামীর সাথে অভিমান করে পিতৃবাড়ি বাঁশখালীর সরলে চলে আসেন। সেখান থেকে আর যায় নি।'


    মালেকা বানুর স্মৃতিবিজড়িত মসজিদ এখন কালের স্বাক্ষি: 

    মালেকা বানুর স্মৃতিবিজড়িত মসজিদ এখন কালের স্বাক্ষি
    কালের স্বাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মালেকা বানুর স্মৃতিবিজড়িত যে মসজিদ!- ছবি: শিব্বির আহমেদ রানা

    সাত পুত্র সন্তান ও এক কন্যার জনক আমির মোহাম্মদের আদরের একমাত্র দুলারী মালেকা বানুর বিয়ের পর নিঃসঙ্গ পিতা, কন্যার স্মরণে বাঁশখালীর সরলে নির্মাণ করেন একটি মসজিদ ও বিশালাকার দিঘী। যা ইতিহাসে মালেকা বানুর মসজিদ ও দিঘী নামে পরিচিত। মসজিদে ফরাসি ভাষায় একটি শিলালিপি ছিল এমন তথ্য থাকলেও বর্তমানে তা আর নেই। জনশ্রæতিতে জানা যায়, পরবর্তীতে ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন দূর্যোগে বিলীন হয়ে যায় ফরাসী ভাষায় লিপিবদ্ধ শিলালিপিটি। শত শত বছরের প্রাচীন ইতিহাসের স্মৃতিবহ মসজিদটির প্রকৃত তথ্য জানা এখনও সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে বিশাল দীঘিটি বর্তমানে ভরাটের দ্বার প্রান্তে দীঘির পুরো অংশ জুড়ে এখন লবণের মাঠ ও মাছের ঘেরের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। মালেকা বানুর মসজিদ পুনঃসংস্কার করে এর একতালা বর্ধিতাংশ নির্মাণ করা হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে মূলকাঠামোতে, সাজিয়েছে নতুন রুপে। তবে দিঘীটা আর নেই। এখানে একটি কমপ্লেক্স করা হলে সমৃদ্ধভাবে মালেকা বানুর স্মৃতি জায়গা করে নিবে ব্যাপকভাবে। ইতিহাসের নিদর্শন রক্ষার জন্য মালেকা বানুর মসজিদ সংরক্ষণ করা জরুরি বলে এলাকাবাসী মনে করেন।

    যেভাবে যাবেন: 

    চট্টগ্রাম শহরের বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল হতে বাঁশখালীগামী স্পেশাল বাস/ সুপার সার্ভি/এসআলম/সানলাইন সার্ভিসে করে বাঁশখালী উপজেলার মিয়ার বাজার স্টেশনে নেমে প্রধানসড়কস্থ পশ্চিম দিকে হারুনবাজার সড়ক দিয়ে সিএনজি অটোটেক্সি, মাইক্রোবাসে সরাসরি সরল বাজার যেতে হবে। সরল বাজার থেকে সামান্য দূরে পশ্চিম দিকে একই গাড়ী নিয়ে মালেকা বানুর স্মৃতিবিজড়িত দীঘি ও মসজিদ স্পটে যাওয়া যাবে।


    শেয়ার করুন

    সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    1মন্তব্যসমূহ

    খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    #buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

    Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
    Ok, Go it!
    To Top