সুনসান নির্জনতা, দূরে কোথাও অপরিচিত পাখির ডাক, গহীন বনে দীর্ঘ শালগাছের
মগ ডালে দুষ্টু কাঠঠোকরা পাখিটি তার লম্বা চঞ্চু দিয়ে গাছের ডালে অবিরাম
আঘাত করে চলছে। হঠাত্ আগমন টের পেয়ে পাখিটি পালকের ঝাপটায় নীরবতা ভেঙ্গে
দিয়ে হারিয়ে গেল টিলাগড় ইকো-পার্কের গহীনে। সেইসাথে গাছের পাথায় আটকে থাকা
বৃষ্টির ফোটা শরীরে শীতল পরশ দিল। এদিকে বৃষ্টিভেজা বেজীটিও বনের কোণে
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার হারিয়ে গেল বনে। বনবিড়াল আর ঘুঘু সতর্ক পা ফেলে
নিরাপদ দূরত্বে এদিক-সেদিক করছিল। বাতাসের হিল্লোলে বৃক্ষরাজির সবুজ পাতা
আনন্দে যখন তখন নেচে ওঠে। একই অবস্থা এখানকার নানা প্রজাতির জীবজন্তু ও
সরীসৃপ প্রাণীগুলোরও। একসময় এই বনে দল বেঁধে বানর ঘুরত। এখন আগের মত বানর
চোখে পড়ে না।
শত ব্যস্ততার মধ্যে দু‘দণ্ড শান্তির জন্য নির্জন প্রকৃতির কোলে কিছু সময়ের
জন্য হারিয়ে যেতে সিলেট এমসি কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
এলাকা পাড়ি দিয়ে বন, পাহাড়, টিলাঘেরা স্থানে টিলাগড় ইকো-পার্ক প্রতিষ্ঠা
করা হয়। নগরীর উত্তর-পূর্ব কোণে শহর থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে এর
অবস্থান। ১১২ একর বন নিয়ে টিলাগড় এলাকায় দেশের তৃতীয় ইকোপার্কটি স্থাপিত
হলে এর নামকরণ করা হয় ‘টিলাগড় ইকোপার্ক সিলেট’। টিলাগড় ইকো পার্কটি কয়েকটি
ছোট ছোট টিলা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। এটি সিলেট বনবিভাগ, বন অধিদপ্তর, পরিবেশ
ও বন মন্ত্রণালয়ের ইকো পার্ক প্রকল্প।
সরকারি উদ্যোগে রাজধানীর মিরপুর ও রংপুরের পর সরকারিভাবে সিলেটে এটি তৃতীয়
ইকো-পার্ক প্রকল্প। ২০১২ সালের ৩ অক্টোবরে মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ
মন্ত্রণালয়ের এক সভায় সিলেটে দেশের তৃতীয় সরকারি ইকো-পার্ক নির্মাণের
সিদ্ধান্ত হয়। ঐ বছরের ৯ নভেম্বর সিলেটের ইকোপার্ক এলাকায় প্রস্তাবিত
চিড়িয়াখানার জায়গা পরিদর্শন করেন তত্কালীন মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ
প্রতিমন্ত্রী মো. আব্দুল হাই। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত প্রকল্প
এলাকা পরিদর্শন করে প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগ্রহ প্রকাশ
করেন।
উদ্ভিদ সম্পদের প্রাচুর্য্যময় সিলেটের এই ইকো-পার্কে দেশিয় জীবজন্তুর একটি
বড় আবাসস্থল হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পার্কটি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের
অধীনে এবং জায়গাটি বনবিভাগের থাকায় আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় এ নিয়ে কিছুটা
জটিলতার সৃষ্টি হলে পরে প্রকল্পটি বনবিভাগ বাস্তবায়ন করে।
বন বিভাগ সিআইসিট স্টাফ ব্যারাক, জেব্রা শেড, সাইড ড্রেন, টিকেট কাউন্টার,
অভ্যন্তরীণ বিদ্যুত্ সংযোগ, বন বিড়াল ও গন্ধ গোকুলের ঘর নির্মাণ, ৪টি
সেন্ট্রি পোস্ট নির্মাণ, ২টি বক্স কালভার্ট নির্মাণ, ফিজেন্ট এভিয়ারী
নির্মাণ, বিদ্যমান পুকুর পুনঃখনন, ফিড এন্ড ফুড প্রিজারভেশন স্টোর নির্মাণ,
পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, বাউন্ডারী ওয়াল নির্মাণ, ৫টি আরসিসি বেঞ্চ নির্মাণ,
তৃণভোজী প্রাণীর শেড ও বেষ্টনী নির্মাণ, পানি সরবরাহ শ্যালো টিউবওয়েল
নির্মাণ কাজ শেষ করেছে। এছাড়াও আহত ও উদ্ধারকৃত বন্যপ্রাণীর চিকিত্সার জন্য
বন্যপ্রাণীর পুনর্বাসন ও হাসপাতাল স্থাপন করা হবে।
ইকো-পার্কটিতে রয়েছে ঘন গাছ-গাছালি। শাল, গর্জন, চাপলিশ, কদম, জারুল,
চম্পা, নাগেশ্বর, দেবদারু, ছাতিম, সোনারু, হরিতকি, বহেরা, অর্জুন, বড়ই,
রাতা, তুন লোহাকাঠ, বনাক, রামডালা, জামসহ নানা প্রজাতির বেত গুল্ম, বীরুত্
এবং লতা এই পার্কটিকে অপূর্ব রূপ নিয়েছে।