আল্লাহ তায়ালা বলেন- রমজান মাস, যে মাসে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য এবং সঠিক পথের বর্ণনা ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বর্ণনা করার জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে আল কোরআন (সূরা-বাকারা, আয়াত-১৮৫)। আল কোরআন একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের সকল বিষয়ের দিকনির্দেশনা এতে রয়েছে। মানব জাতি আদম (আ.)-এর বংশধর। একজন মানুষ মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে আল্লাহতে বিশ্বাস রেখে মুহাম্মদ (স.)কে শেষ নবী মেনে নিয়ে, নবী মুহাম্মদ (স.)-এর উপর অবতীর্ণ আল-কোরআনকে মেনে চললে তাকে জান্নাতি হিসেবে গণ্য করা যায়। পক্ষান্তরে আদম (আ.)-এর বংশধর একজন ইহুদি বর্তমানে আল্লাহকে বিশ্বাস করে, আল্লার নবী মুসা (আ.)কে মেনে নিয়ে মুসা (আ.)-এর উপর অবতীর্ণ তাওরাত কিতাবকে মেনে চললে তাকে কি জান্নাতি হিসেবে গণ্য করা যাবে? কিংবা একজন খ্রিস্টান যদি আল্লাহকে বিশ্বাস করে আল্লাহর নবী ঈসা (আ.)কে নবী মেনে তার উপর অবতীর্ণ আল্লাহর কিতাব ইঞ্জিল মেনে চলে তাকে কি জান্নাতি গণ্য করা যাবে? কেন এ পার্থক্য? মুসা (আ.) ও ঈসা (আ.) আল্লাহর নবী এবং তাওরাত, ইঞ্জিল আল্লাহর কিতাব। তবে বর্তমানে এ গুলো মেনে চললে কেন মুক্তি পাওয়া যাবে না? এর কয়েকটি কারণ রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম কারণ হল- তারা তাদের কিতাবের আইনকানুনগুলো নিজেদের সুবিধা মত লিখে দিয়ে কিতাবের মধ্যে পরিবর্তন করেছে। আল-কোরআন নবী মুহাম্মদ (স.)-এর উপর অবতীর্ণ সর্বশেষ আসমানী কিতাব যার মধ্যে কোন কিছু লিখে পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। কেননা আল্লাহ বলেন- নিশ্চয় আমি একে অবতীর্ণ করেছি এবং নিশ্চয় আমি ইহাকে সংরক্ষিত রাখব (সূরা হিজর-৯)। এ জন্য দেখা যায় এত বিশাল গ্রন্থ হওয়ার পরও লক্ষ লক্ষ লোক সহজে তা মুখস্থ করে ফেলছে। বহু অন্ধ ব্যক্তি শুধু শুনে শুনে তা মুখস্থ করে ফেলছে। নামাজে বা তিলাওয়াতে ভুল করলে পিছন থেকে লোকমা দিয়ে, ছাপানোতে ভুল করলে একজন হাফেজ তিলাওয়াতের সাথে সাথে তা সংশোধন করে দিবে। আল্লাহ জিম্মাদারী নিয়েছেন বিধায় পড়ায় বা লিখায় কোরআনে পরিবর্তনের অবকাশ নেই কিন্তু আমলের (বাস্তবায়নের) ক্ষেত্রে করা না করার স্বাধীনতা মানুষকে দেয়া হয়েছে। সে সাথে বাস্তবায়ন করলে জান্নাতি হিসেবে গণ্য, আর বাস্তবায়ন না করলে জাহান্নামের শাস্তির ঘোষণা দেয়া আছে। কোরআনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন না করে আমরা যদি কিছু ক্ষেত্রে তা মেনে চলি আর কিছু ক্ষেত্রে কোরআনের বিধান বাদ দিয়ে নিজেদের রচিত আইনকানুন মেনে চলি তবে সে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সাথে আমাদের পার্থক্য কোথায়? আল্লাহ বলেন- তোমরা কি আমার কিতাবের কিছু অংশ মেনে চল এবং কিছু অংশ অস্বীকার কর। যে এরূপ করবে সে দুনিয়ায় কষ্টকর লাঞ্ছিত জীবনযাপন করবে এবং কিয়ামতে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হবে। (সূরা বাকারা -৮৫) বাস্তবতায় দেখা যায়, আমাদের দেশে ধর্মভীরু ব্যক্তিগণ আল-কোরআনের নিদের্শনা অনুযায়ী ব্যক্তিগত ইবাদাত যেমন- নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, পবিত্রতা অর্জন, হালাল রুজি, তাছবিহ, জিকির, পর্দা, পোশাক ইত্যাদি পালন করেন। আবার সামাজিকভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশনা যেমন- লেনদেন, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের হক আদায়, সাম্য, বিবাহবন্ধন, সমাজ সেবামূলক কার্যাদি ইত্যাদিও অনেকটা পালন করেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাস্তবায়নের নিদের্শনা যেমন- আল্লাহর আইন ও রাসূল (স.) প্রদর্শিত রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্যনীতি, আল-কোরআনের ফৌজদারী ও দেওয়ানী দ- বিধি অনুযায়ী বিচার কার্য পরিচালনা এ ক্ষেত্রে উদাসিন, এ বিষয়টির বাস্তবায়নের চেষ্টাও করেন না এবং গুরুত্ব অনুধাবন করেন না। অনেকে আবার এটাকে রাজনীতি বলে মনে করে এর থেকে দূরে থাকেন। আল-কোরআনে ৬৬৬৬ আয়াতের মধ্যে কেউ যদি বলে আমি ৬৬৬৫ আয়াত মানি একটি আয়াত অস্বীকার করি তবে কি সে ঈমানদার থাকবে? তাহলে কোরআনের কিছু অংশ মেনে কছিু অংশ না মানলে তার অবস্থা কি হবে তা কি বিবেক দিয়ে চিন্তা করি? উদাহরণ স্বরূপ আল-কোরআনের একটি দ- বিধি তুলে ধরছি: আল্লাহ বলেন, অবিবাহিত যুবক-যুবতী যদি ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তাদের প্রত্যেককে একশত করে বেত্রাঘাত কর। (সূরা নুর, আয়াত-২) প্রশ্ন হল এ ফৌজদারী শাস্তি কার্যকর করবে কে? কোন মসজিদের ইমাম, না কি সামাজের মাতব্বর? কোন ব্যক্তি কি শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা রাখে? ব্যক্তি শাস্তি দিলে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থের সুযোগ থাকে। নবী (স.)-এর যুগ ও পরবর্তী খলিফাদের যুগে এ শাস্তি দিয়েছিল কাজী অর্থাৎ বিচারক বা আদালত। তার মানে শাস্তি দিবে রাষ্ট্র। বিশ্ব মুসলমানের রাষ্ট্রীয় আইনে কি এ ব্যবস্থা আছে? যদি না থাকে তবে কোরআনের এ অংশটি বাদ দেয়া হল। এমনিভাবে কোরআনের বিধান হল সুদ হারাম। রাষ্ট্রীয় আইনে সুদভিত্তিক ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি বৈধ। কোরআনের বিধান ব্যভিচার হারাম। রাষ্ট্রীয় আইনে কোন নারী কোর্টে এফিডেভিট করে বা সরকারী অনুমতি নিয়ে সরকার অনুমোদিত পতিতা পল্লীতে কক্ষ ভাড়া নিয়ে ব্যভিচারের দোকান খুললে তা বৈধ। কোরআনের বিধান মদ হারাম। রাষ্ট্রীয়ভাবে লাইসেন্স করে মদ বিক্রির বার, ক্লাব, দোকান খোলার সুযোগ রয়েছে। এমনিভাবে কোরআনের বিধানের বিপরীত অসংখ্য মানব রচিত বিধান প্রচলিত রয়েছে। তবে রমজানে অবতীর্ণ কোরআনের উপর পরিপূর্ণ আমল (বাস্তবায়ন) কীভাবে হবে? আল্লাহ বলেন- নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি যেন তুমি সে অনুযায়ী মানুষের মাঝে বিচার ফায়সালা করতে পার, যা আল্লাহ তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন, তুমি খেয়ানতকারীদের সাহায্য ও সমর্থনকারী হয়ো না (সূরা নিসা-১০৫)। তিনি আরো বলেন- আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী মানুষের মধ্যে মীমাংসা করবে তাদের মনের খেয়াল খুশিমত কাজ করবে না (সূরা মায়েদা-৪৯)। আরো কঠোর ভাষায় আল্লাহ বলেছেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব অনুযায়ী হুকুম (বিচার, মীমাংসা ও রাষ্ট্র) পরিচালনা করবে না সে কাফির (সূরা মায়েদা-৪৪)। রাসূল (স.) বলেন- আল্লাহর কিতাব তাতে রয়েছে অতীত জাতির ইতিহাস, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে তোমাদের পারস্পরিক বিষয় সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় আইনকানুন। বস্তুত উহা এক চূড়ান্ত বিধান উহা কোন বাজে জিনিস নয় (তিরমিজি)। রাসূল (স.) আরো বলেন- ইসলাম ও রাষ্ট্র যমজ ভাই। নিজের সঙ্গী ব্যতীত একে অপরে নিখুঁত থাকতে পারে না। ইসলাম হচ্ছে ভিত্তি এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হচ্ছে রক্ষক। যার ভিত্তি নেই তা ধ্বংস হয়ে যায় আর যার রক্ষক নেই তা হারিয়ে যায় (কানযুল উম্মাল)। তাই নবী-রাসূলগণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন যেন সহজে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা যায়। হযরত ইউছুফ (আ.) প্রথমে চৌদ্দ বছর মিশরে খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন পরবর্তীতে রাষ্ট্র প্রধান হয়েছিলেন। দাউদ (আ.) রাষ্ট্র প্রধান থেকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার পরিচালনা করেছেন। হয়ত সোলায়মান (আ.)-এর রাজত্ব ছিল পৃথিবীব্যাপী, তিনি মন্ত্রী পরিষদ নিয়ে সিংহাসনে বসে বাতাসের সাহায্যে রাজ্য পরিদর্শনে যেতেন। ফেরআউনী আইনের বিপক্ষে ছিল মুসা (আ.)-এর লড়াই, নমরুদী আইনের বিরুদ্ধে ছিল ইবরাহিম (আ.)-এর লড়াই। জালুতকে পরাজিত করে তালুত (আ.) আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলোর বর্ণনা কোরআনে রয়েছে। শেষ নবী মোহাম্মদ (স.)-এর মদিনাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, প্রাদেশিক শাসন কর্তা নিয়োগ, সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ ও পরবর্তী খলিফাগণ রাষ্ট্রীয়ভাবে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ইসলামের ইতিহাসে সামান্য জ্ঞানী ব্যক্তিও তা জানেন। প্রশ্ন হতে পারে যদি আল্লাহর আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা হয় তবে এদেশের অন্য ধর্মাবলম্বীদের কি হবে? রাসূল (আ.)-এর যুগে ও পরবর্তী খলিফাদের যুগেও ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা ছিল। তারা তাদের ধর্মের আইন অনুযায়ী তাদের জীবন পরিচালনা করেছে। ধর্ম পালনে সকল ধর্মের লোক স্বাধীন থাকবে এটাই ইসলামের বিধান। বাংলাদেশে আংশিক সামান্য দু-একটি ক্ষেত্রে হলেও ধর্মীয় বিধান রাষ্ট্রীয়ভাবে রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ যদি প্রশ্ন করি একজন মুসিলম ব্যক্তি এক ছেলে এক মেয়ে ও তিন বিঘা জমিন রেখে মারা গেল অপরদিকে একজন হিন্দু ব্যক্তি এমনিভাবে এক ছেলে এক মেয়ে ও তিন বিঘা জমিন রেখে মারা গেল। কে কতটুকু সম্পদ পাবে? স্বাভাবিক জবাব আসবে মুসলিম ব্যক্তির ছেলে দুই বিঘা ও মেয়ে এক বিঘা জমিন পাবে। হিন্দু ব্যক্তির ছেলেই তিন বিঘা জমিন পাবে মেয়ে কোন জমিন পাবে না। উল্লেখিত বন্টনটি সম্পূর্ণ ধর্মীয় আইনের বণ্টন এবং রাষ্ট্র ও এ ধর্মীয় আইনটি উভয় ধর্মের স্বকীয়তা বজায় রেখে রাষ্ট্রীয় আইনে বহাল করেছে বিধায় গুরুত্বপূর্ণ এ সম্পদ বণ্টন আইন উভয় ধর্মের বিধান অনুযায়ী বণ্টন হচ্ছে। তা হলে রাষ্ট্রীয় আইন যদি সকল ধর্মের আইনের সাথে এমনিভাবে সামঞ্জস্য রেখে প্রণয়ন করা হয় তবে সকল ধর্মের লোক তাদের ধর্মীয় বিধান পালন করার পুরোপুরি সুযোগ পাবে। রাষ্ট্র যদি এই দায়িত্ব হাতে নেয় কোরআনের বিধান পরিপূর্ণ পালন সহজে সম্ভব। রাষ্ট্র এ দায়িত্ব পালন না করায় কতিপয় ইসলামী চিন্তাবিদ ও একাধিক ইসলামী দল গণতান্ত্রিক উপায়ে সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোরআনের পথে আহ্বানের পথ কন্টকপূর্ণ। কোরআন বিরোধীরা তাদের প্রতিবন্ধক হবে এটাই স্বাভাবিক। বিশুদ্ধ হাদিসের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বুখারী শরীফের প্রথম পৃষ্ঠায় নিয়তের হাদিসের পরই বর্ণিত আছেÑ নবী (সা.)-এর নিকট যখন হেরা গুহায় ওহী আগমন করল তিনি ভীত অবস্থায় ঘরে এসে কম্বল মুড়ি দিয়ে কিছু সময় অতিবাহিত করলেন। ভীতিভাব কমে গেলে নবীজীর স্ত্রী খাদিজা (রা.) তাকে তৎসময়ের বড় আলেম ওরাকা বিন নওফলের নিকট নিয়ে গেলেন। সব শুনে ওরাকা বলল- এতো সে ফেরেশতা যে হযরত মুসা (আ.)-এর নিকট ওহী নিয়ে আসত। তোমার নিকট ঐ ফেরেশতা ওহী নিয়ে এসেছে। ভাতিজা লোকেরা তোমাকে যখন নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দিবে আমি ঐ সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকলে তোমাকে সহযোগিতা করব।