আন্তর্জাতিক
মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফের) ঋণের ১৬০ কোটি ইউরোর কিস্তি দিতে শেষ পর্যন্ত
ব্যর্থ হয়েছে গ্রিস। গত মঙ্গলবার (বাংলাদেশ সময় বুধবার ভোর চারটা) কিস্তি
শোধের সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ায় গ্রিস এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণখেলাপী দেশ। উন্নত
বিশ্বের কোনো দেশের এমন ঋণখেলাপী হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম।
এদিকে,
গ্রিসের ‘না’ ভোটের পক্ষেই মত দিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ
স্টিগলিজত্ এবং পল ক্রুগম্যানের মতো অর্থনীতিবিদরা। তাঁদের আশঙ্কা, আবার
ব্যয় কাটছাঁটের শর্তগুলো মানলে গ্রিসের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
কারণ, বিগত পাঁচ বছরে ব্যয় হ্রাসের পর গ্রিসের মোট অভ্যন্তরীণ উত্পাদন
(জিডিপি) প্রায় ২৫ শতাংশ কমে গেছে। তার থেকে ইউরো ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে
নিজের মুদ্রায় ফিরে গেলে গ্রিসের সুবিধা হবে বলেই তাঁদের মত। তবে
এক্ষেত্রে মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে গ্রিসের রফতানি ক্ষেত্রে বিকাশের
সম্ভাবনা থাকবে। তাই প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উপরে চাপ পড়লেও
গ্রিসের দীর্ঘমেয়াদী লাভ হবে। ইউরো ব্যবস্থা আদৌ বজায় রাখা সম্ভব কিনা তা
নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও ঋণদাতাদের এখনো আশা শেষ পর্যন্ত
গ্রিস ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাবে না। তবে শেষ পর্যন্ত ইউরো থেকে গ্রিস
বেরিয়ে গেলে কী হবে? স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়নে রাজয় মনে করেন, এটি হলে
স্পষ্টতই একটি নেতিবাচক বার্তা যাবে মানুষের কাছে। মানুষ মনে করতে পারে,
একটি দেশ যদি ইউরো ছাড়তে পারে তাহলে ভবিষ্যতে অন্যরাও পারবে।
এদিকে
গ্রিসের জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক উদ্ধার প্যাকেজের (বেইলআউট) চুক্তির
মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ফলে সঙ্কটের শেষ কিনারায় দেশটি। এ অবস্থায় হাজার
হাজার কোটি ইউরোর দেনায় ডুবে থাকা গ্রিসের জন্য এখন নতুন করে কোথাও থেকে ঋণ
পাওয়া সহজ হবে না। যদিও আইএমএফের সময়সীমা শেষের কয়েক ঘণ্টা আগে অবশ্য
আন্তর্জাতিক উদ্ধার প্যাকেজের মেয়াদ বাড়ানোর একটি আবেদন জানিয়েছিল গ্রিস।
কিন্তু ইউরো জোনের মন্ত্রীরা সেই আবেদনে সাড়া দেননি। তবে তারা আলোচনা
চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে মত দিয়েছেন। আর ঋণদাতাদের শর্তের বিষয়ে আগামী রবিবার
অনুষ্ঠেয় গণভোটের উপরই এখন সব কিছু নির্ভর করছে। যদিও গ্রিসের
প্রধানমন্ত্রী ঋণদাতাদের কিছু শর্তে ছাড় দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলে
গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে। খবর:রয়টার্স, বিবিসি।
ঋণ
পরিশোধে ব্যর্থ: আইএমএফের ঋণের কিস্তি শেষ পর্যন্ত গ্রিস পরিশোধ করতে
পারবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আগেই দেখা দিয়েছিলো। মঙ্গলবার গ্রিস সরকার
ঘোষণা করেছে আইএমএফ’র ঋণের কিস্তি তাদের পক্ষে শোধ করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে
ঋণদাতাদের কাছে দুই বছরের জন্য আর্থিক উদ্ধার প্যাকেজ ও বিদ্যমান ঋণ
পুনর্গঠনেরও দাবি জানিয়েছে দেশটির সরকার। মঙ্গলবার ওয়াশিংটনের সময় অনুযায়ী
সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে আইএমএফকে ১৬০ কোটি ইউরো গ্রিসকে দিতে হতো। এদিনই
আন্তর্জাতিক উদ্ধার প্যাকেজের আবার নতুন ঋণ নিয়ে শর্ত মানার শেষ দিন ছিল
গ্রিসের। কিন্তু গ্রিস সরকার আর্থিক প্যাকেজের শর্ত মানেনি বরং সুকৌশলে
গণভোটের ঘোষণা করে সেই শর্ত মানার সময়ও খানিকটা পিছিয়ে দিয়েছে। আর শেষ
পর্যন্ত ঘোষণা দিয়েছে তারা আইএমএফের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না।
গ্রিসের
ব্যর্থ হওয়ার বিষয়ে আইএমএফের মুখপাত্র গ্যারি রাইস বলেন, কেবল বকেয়া
পরিশোধের পরই আইএমএফের পরবর্তী তহবিল পাবে গ্রিস। শেষ মুহূর্তে গ্রিস ঋণ
পরিশোধের সময় বাড়ানোর অনুরোধ করেছিল বলে জানান তিনি।
উদ্ধার
প্যাকেজে ইইউ’র সাড়া মেলেনি: আইএমএফের কিস্তি পরিশোধের জন্য গ্রিস সরকার
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর কাছে নতুন করে দুই হাজার ৯১০ কোটি ডলার ঋণ
সহায়তা চাইলেও তাতে সাড়া মেলেনি। ইউরোজোনের অর্থমন্ত্রীরা মঙ্গলবার
সন্ধ্যায় তাদের এ প্রস্তাব নিয়ে টেলি কনফারেন্সে আলোচনা করলেও কোনো
সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। তারা বলছেন, গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি
সিপ্রাসের সর্বশেষ ঋণ প্রস্তাব নিয়ে বুধবার (ইউরোপের সময় অনুযায়ী) আলোচনা
করবেন। তবে ওই আলোচনায় গ্রিসের জন্য কোনো শুভ বার্তা আসবে কিনা তা নিয়েও
সংশয় রয়েছে। নতুন করে ঋণ চাওয়ার পাশাপাশি ঋণ পুনর্গঠনও চাইছেন সিপ্রাস, যে
বিষয়ে কোনো ধরনের ছাড় দিতে রাজি নয় ঋণদাতারা।
ইউরো
জোনের অর্থমন্ত্রীদের গ্রুপের চেয়ারম্যান জেরোয়েন ডিজেলব্লোয়েম গ্রিসকে
সতর্ক করে বলেছেন, নতুন সহায়তার ক্ষেত্রে এথেন্সকে স্বাগতম। তবে তাদের শর্ত
মেনে আসতে হবে। এক্ষেত্রে গ্রিক সরকারের রাজনৈতিক অবস্থানের পরিবর্তন হতে
হবে, যা এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
এদিকে,
গ্রিক প্রধানমন্ত্রী ঋণদাতাদের কিছু শর্ত মেনে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন
বলে দ্য ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের এক খবরে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, আলোচনা
ভেস্তে যাওয়ার আগে উত্থাপিত বেশ কিছু শর্ত মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন
সিপ্রাস। তবে এক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনতে বলেছিলেন। মূলত ভ্যাট ছাড় ও
অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধির দুটি বিষয়ে পরিবর্তন আনতে বলেছিলেন তিনি। গ্রিসের
জাতীয় টেলিভিশনেও বলা হয়েছে, সামান্য কিছু পরিবর্তন আনলে প্রধানমন্ত্রী
চুক্তিতে সম্মত হতেন। তবে জার্মান অর্থমন্ত্রী উলফগ্যাং চয়েবল জানিয়েছেন,
রবিবারের গণভোটের আগে উদ্ধার প্যাকেজ নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না। আর জার্মান
চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা ম্যারকেলও গণভোটের আগে কোনো ধরনের সমঝোতার কথা নাকচ
করেছেন।
গণভোটেই
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসছে:সমপ্রতি দুই পক্ষের মধ্যে তিক্ত আলোচনার পর
এথেন্স ও ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়। নতুন করে উদ্ধার
প্যাকেজের (বেইল আউট) জন্য গ্রিসকে কর বাড়ানোর পাশাপাশি জনকল্যাণমূলক ব্যয়
কমানোসহ কঠিন আর্থিক পুনর্গঠনের শর্ত দেয় ইইউ। তাদের কঠোর ব্যয় সঙ্কোচনের
শর্তে সায় দেয়নি গ্রিসের বামপন্থি সরকার। নতুন বেইল আউট প্রস্তাব নিয়ে ৫
জুলাই গণভোটের আয়োজন করেছে গ্রিস সরকার। কয়েক শ’ কোটি ইউরোর বেইল আউট তহবিল
নেয়ার জন্য ঋণদাতাদের দেয়া কঠোর শর্তগুলো গ্রহণ নাকি প্রত্যাখ্যান করা হবে
আগামী রবিবারের গণভোটে সেই সিদ্ধান্তই জানাবে গ্রিকরা।
৪০
বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস অবশ্য ‘না’ ভোট দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান
জানিয়েছেন। দাতাদের শর্ত মেনে বেইল আউট তহবিল নেয়ার পক্ষে বেশি ভোট পড়লে
দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে দেয়া এক
সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, গ্রিসের জনগণ যদি একজন লাঞ্ছিত প্রধানমন্ত্রী চান,
তাহলে সরকারের বাইরে এ রকম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য অনেকেই তৈরি আছেন।
কিন্তু আমি তা হবো না। তার এ বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছেন দাতারা।