শীতের আবহ শুরু হতে না হতেই এখন বিকালে রং-বেরংয়ের কাপড় টাঙিয়ে ও মাটির উঁচু ঢিবির চারপাশে বাঁশের ঘের তৈরি হওয়া দেখলেই এলাকার মধ্যবয়স্ক ও বৃদ্ধ গ্রামবাসীর মনে নাচন লাগে। কিশোর, তরুণ-যুবা বয়স্কদের মধ্যেও এক ধরনের চাঞ্চল্য তৈরি হয়। তবে তার আর আগের মতো নয়।
আকাশ-সংস্কৃতি ও স্মার্টফোনের যুগে আর আগের মতো চাহিদা না থাকায় দিন দিন তাই জৌলুস ?হারাতে বসেছে ঠাকুরগাঁওয়ের এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য ‘ধামের গান’। রং-বেরংয়ের কাপড় টাঙিয়ে ও মাটির উঁচু ঢিবির চারপাশে বাঁশের ঘের দিয়ে সেখানে এ গান অভিনয় সহকারে গাওয়া হয়। সাধারণত শীতের আগমনী থেকে সারা শীত মৌসুমজুড়ে এর আসর বসে জেলার বিভিন্ন এলাকায়। ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামীণ জনপদে এ গানের কদর এখনো কিছুটা থাকলেও আগের মতো তার আবেদন নেই। ফলে এক সময়ের এ অঞ্চলের শীর্ষ বিনোদনের মাধ্যম ধামের গান হারিয়ে যেতে বসেছে কালের আবর্তে। এর সঙ্গে জড়িত কলা-কুশলীদের দাবি, আকাশ-সংস্কৃতির প্রভাব আর তেমন অর্থকড়ি না থাকায় এখন আর আনাগোনা নেই ধামের দলের, আসরও জমে না তেমন। জেলা প্রশাসনের আশ্বাস, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ধামের গানের স্বীকৃতি ও প্রসারের জন্য চেষ্টা করা হবে।
ধামের গানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও বয়ঃবৃদ্ধদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঠাকুরগাঁওয়ের স্থানীয় লোকনাট্যই ‘ধামের গান’ নামে পরিচিত। একে অঞ্চলভেদে শরীগান বা সোরীগান বলেও চিহ্নিত করা হয়। ধামের আভিধানিক অর্থ গৃহ বা স্থান। কারো কারো মতে স্থানীয় ধর্মীয় উত্সব উপলক্ষে যে স্থানে পুণ্যার্থীদের সমাগম হয় তাকেও ধাম বলে। এই ধামে উত্সবের আনন্দ ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে যে সাংস্কৃতিক আয়োজন বা পরিবেশনা তাই মূলত ধামের গান। ঠাকুরগাঁওয়ে এটা ধামের গান নামে পরিচিত হলেও পাশের জেলা পঞ্চগড়ে হুলির ধাম বা হোলি গান এবং দিনাজপুরে পালাটিয়া গান বা মাড়াঘুরা গান নামে এর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। তবে ব্যাপকভাবে এ গানের আসর বসে ঠাকুরগাঁওয়ে। অন্যান্য লোকনাট্যের মতো ধামের গানেও নৃত্য, গীত ও অভিনয়ের মাধ্যমে একটি কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়। তবে আসরে বসেই ঠাকুরগাঁওয়ের আঞ্চলিক ভাষায় তাত্ক্ষণিকভাবে এ গান রচনা ও পরিবেশন করেন ধামের গানের শিল্পীরা।
এ গানের প্রচলনের সঠিক তথ্য জানা যায়নি। ৯০ বছর বয়সী প্রবীণ ধামের গানের শিল্পী সদর উপজেলার পালপাড়া গ্রামের মনোজ কুমার রায় জানায়, এ গানের কথা তিনি তার বাপ-দাদার কাছে শুনেছেন। ১৬ বছর বয়স থেকেই তিনি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুরুর দিকে আসর থেকে তিনি পারিশ্রমিক হিসাবে পেতেন ৩০/৪০ টাকা। বয়সের কারণে বর্তমানে আর গান করা হয়ে ওঠে না। তবে বাড়ির আশপাশে ধামের আসর বসলে ছুটে যান তিনি।
ধামের গানের দল পুরুষকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। প্রতিটি দলে ১২ থেকে ২৫ জন সদস্য থাকেন। চরিত্র অনুযায়ী পুরুষরাই নারী সেজে অভিনয় করেন আসরে। সাধারণত শীতের দিনে বিকাল বা সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি চলে আসর। ধামের দলের সদস্যরা পুরুষ হলেও এ অঞ্চলের নারীদের মধ্যেই ধামের গানের জনপ্রিয়তা বেশি। তাই সংসারের ?কাজকর্ম সামলে সন্ধ্যার আগেই আসরে এসে বসেন গ্রামের কিশোরী-তরুণী ও গৃহবধূরা। বাদ যান না বৃদ্ধারাও। ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ঠাকুরগাঁওয়ের ধামের গান নিয়ে গবেষণা করেছেন যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে।
তিনি বলেন, এ গান সাধারণত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আয়োজন করেন। স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে এ গানের আয়োজন করা হয়। বর্তমানে এ গানে যাত্রাপালার গল্প উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু এটি মূল ধামের গান নয়। তিনি জানান, বর্তমানে ঠাকুরগাঁওয়ের ৫ উপজেলায় ২০০ বা তারও বেশি ধামের গানের দল রয়েছে। কদর ও আর্থিক পসার আগের মতো না থাকলেও এবারো শীতের মৌসুম শুরু হতে না হতেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের লক্ষ্মীপূজা ও কালীপূজাকে কেন্দ্র করে ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ধামের গান।
ধামের আসরে শিল্পীদের নেই তেমন বসার ব্যবস্থা। থাকে না আলোকসজ্জা। খোলা আকাশের নিচে বসেই প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হয় অভিনয় মঞ্চে। অর্থের জোগান না থাকায় শিল্পীদেরও উপযুক্ত সম্মানী দিতে পারেন না আয়োজকরা। তবু সামান্য পারিশ্রমিকেই শিল্পীরা খুশি মনে করে যান ধামের গান। লাইট, মেকআপ, যাতায়াত খরচ বেড়ে গেছে। শিল্পীর তেমন পারিশ্রমিক পান না।
গত কয়েক বছর ধরে ধামের গানের আয়োজন করে আসছেন সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুব্রত সরকার। তিনি বলেন, এ ধরনের উদ্যোগে অর্থের প্রয়োজন হয়। স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে এর আয়োজন করে থাকেন। তার ইউনিয়নের ১৬টি স্থানে এখন ধামের গানের আসর চলছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে তিনি জানান।
এ বছর ধামের গান দেখতে নিজ এলাকা ঠাকুরগাঁওয়ে ছুটে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. ইস্রাফিল শাহিন। তার সঙ্গে এসেছেন ওই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহামান মৈশান ও নাট্য বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী। ধামের গান উপভোগ করে তাদের মন্তব্য, দর্শক-অভিনেতার তাত্ক্ষণিক সম্পর্কই ধামের গানের মূল শক্তি।
অধ্যাপক ড. ইস্রাফিল শাহিন বলেন, অভিনয়ে প্রশিক্ষিত না হলেও তারা নিজস্ব কৌশলে যেভাবে দর্শকদের মাতিয়ে তোলেন তা কোনো অংশে কম নয়।