চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে ছাত্রলীগ। ১৯৮২ সাল থেকে টানা দুই যুগের বেশি সময় ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতো ছাত্রশিবির। সেই সময় কথায় কথায় প্রতিপক্ষের কর্মী খুন, হল দখল ও অস্ত্রবাজি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকা তখন ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ২০০৯ সালে দেশে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর চবিতে শিবিরের একক আধিপত্যের অবসান ঘটে। ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি চলে যায় ছাত্রলীগের হাতে। তবে এই পরিবর্তনে ক্যাম্পাস পরিস্থিতির সামান্যতম উন্নতিও হয়নি। শিবিরের দেখান রক্তপাত ও অস্ত্রবাজির পথেই হাঁটতে শুরু করেছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের দাপটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বর্তমানে ক্যাম্পাসে শিবিরের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। তবে শিবিরের মত আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ছাত্রলীগ। নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দিন সমর্থিত দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পাসের আধিপত্য নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে ছাত্রলীগ। গত চার বছরে ক্যাম্পাসে চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গত দুই বছরে নানা অজুহাতে ২০ বারের বেশি শাটল ট্রেন অবরোধ করেছে ছাত্রলীগ। এ সময় চরম ভোগান্তিতে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ব্যাহত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম। হত্যা, লুটপাট এমনকি মুরগি চুরির মত অপরাধেও ছাত্রলীগ কর্মীদের নাম এসেছে। সংগঠনের সাবেক নেতা-পুলিশ ও সাংবাদিক লাঞ্ছনার অভিযোগ এসেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো আবার আগের মত অস্ত্রের ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত দুটি হল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ২৫ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মামুন হোসাইনকে সভাপতি এবং এমএ খালেদকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সভাপতির বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ছিনতাই, নিয়োগ বাণিজ্য, গ্রুপিংয়ের অভিযোগ ছিল। একসময় মামুনকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তারই এক সময়ের অনুসারীরা। ২০১৪ সালের ১১ জুন শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক সংগঠন কনকর্ড ও ভার্সিটি এক্সপ্রেসের মধ্যে সংঘর্ষের পর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। গত ২০ জুলাই আলমগীর টিপুকে সভাপতি এবং ফজলে রাব্বিকে সাধারণ সম্পাদক করে ঘোষণা করা হয় নতুন কমিটি। তবে নতুন সভাপতি’র বিরুদ্ধেও জোড়া খুনসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্রত্ব না থাকা, সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি এবং পারিবারিকভাবে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। কিন্তু এসব অভিযোগ তিনি মিথ্যা বলে দাবি করেছেন।
গত চার বছরে ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষে তিনজন শিবির কর্মী ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে একজন ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হয়েছে। ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শিবির ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে শিবির কর্মী মুজাহিদ ও মাসুদ বিন হাবিব নিহত হয়। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি ছাত্রলীগ-শিবির রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আমানত হলের শিবিরের সাধারণ সম্পাদক মামুন হোসেন নিহত হয়। একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সংস্কৃত বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র তাপস সরকার। এছাড়া গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর এবং এ বছরের ৩০ এপ্রিল, ৬ জুনসহ বিভিন্ন সময় নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে ছাত্রলীগ। সর্বশেষ গত সোমবার ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত দুটি হল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ২৩৫ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে আসামি করে পৃথক তিনটি মামলা করেছে পুলিশ।
প্রসঙ্গত, ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের আধিপত্য বিস্তারের বলি হিসেবে ১৯৮৬ থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ জন নিহত হয়েছে।সূত্র: ইত্তেফাক অনলাইন