১৩ ঘণ্টায় যা বললেন নূর হোসেন

S M Ashraful Azom
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন র্যাব-পুলিশ হেফাজতে ১৩ ঘন্টা ছিলেন। এ সময় অনেক কথাই বলেন নূর হোসেন। তিনি স্বীকার করেন, সাত খুনের ঘটনা তার পরিকল্পনাতেই হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সম্পর্কে র্যাব-১১ এর সাবেক সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদ জানতেন বলেও তিনি জানিয়েছেন। পুরনো ঢাকায় তারেক সাঈদের জমি নিয়ে সমস্যা ছিল। সেখানে আইনজীবী দিয়ে সহায়তা করার কথা জানিয়েছেন নূর হোসেন। নূর হোসেন বলেন, নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি নোংরা। এখানে সবসময় ‘বস’দের খুশি রাখতে হয়। এটা না করলে টিকে থাকা যায় না। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন ‘বস’ই আমাকে ভারতে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন।
 
টেলিভিশনে টকশোতে কথা বলার সুযোগ দিতে র্যাবের কাছে দাবি জানান নূর হোসেন। তিনি বলেন, তাহলে দেশবাসীর কাছে মনের কথা খুলে বলতে পারবেন।
 
র্যাবের কাছে প্রশ্ন রেখে নূর হোসেন বলেন, ‘আমি তো এখন নেই। তাহলে আমার সিদ্ধিরগঞ্জের সেই সাম্রাজ্য এখন কার দখলে? কারা এখন সুবিধাভোগী?’ নূর হোসেন বলেন, ‘ঘটনার দিন মেজর আরিফ আমার সিদ্ধিরগঞ্জের বাসায় আসে। তখন আমি তাকে বলি, আমার লোক নজরুলকে ফলো করছে। সে কোর্টে হাজির হতে আসলেই আমি জানবো। তখন আমি আপনাকে ইনফর্ম করবো। আপনারা সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেন।’
 
নূর হোসেন বলেন, ‘আমাদের টার্গেট ছিল নজরুল। চন্দন সরকারসহ বাকিরা টার্গেটে ছিল না। যেহেতু প্রত্যক্ষদর্শী কেউ বেঁচে থাকলে ঘটনা জানাজানি হয়ে যাবে, তাই তাদেরকে হত্যা করা হয়।’ এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে বড় অংকের টাকা লেনদেন হয় বলে স্বীকার করেন নূর হোসেন। তবে টাকার অংক বলেননি তিনি। নূর জানান, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে একটি চুক্তিও করা হয়েছিল। কিছু টাকা পরিশোধও করা হয়। অপারেশন সফল হলে বকি টাকা শোধ করার কথা ছিল।
 
নূর হোসেন জানান, নজরুল ১২ থেকে ১৩টি খুনের মামলার আসামি ছিলেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি বেশ দাপুটে ছিলেন। তার বিশাল কর্মী বাহিনী ছিল। নজরুলই ছিলেন তার একমাত্র প্রতিদ্বন্ধী।
 
নূর হোসেন বলেন, ‘আমি কেবল আওয়ামী লীগ নয়, যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের টাকা দিয়েছি। আমার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত সবই আছে। সব দলের সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ছিল।’
 
নূর বলেন, ‘প্রতিনিয়ত র্যাব, পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে এসেছি।’ পুলিশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত চাঁদা দিতেন বলেও দাবি করেন তিনি।
 
নূর হোসেন বলেন, ‘চাঁদা দেয়া ছাড়া আমার টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। পড়াশোনা জানি না। টাকা দিয়ে সবাইকে কিনে রাখতাম। বালু ও ট্রাকের ব্যবসা ছিল। পরিবহনের চাঁদাবাজি থেকে অনেক টাকা আসতো।’  তবে মাদকের ব্যবসা সম্পর্কে কিছু জানাননি নূর হোসেন। সূত্রমতে, নূর হোসেনের টাকার অন্যতম উত্স মাদকের অবৈধ ব্যবসা। এই ব্যবসায় অনেকেই তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।
 
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে নূর হোসেন স্বীকার করেন, সাত খুনের ঘটনার আগে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলা নির্বাচনের সময় তার বাহিনী বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র দখল করে। এ সময় তার লোকজনের হাতেই বালুয়াকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন নিহত হন। এই হামলায় পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান দেওয়ানের স্ত্রীও নিহত হন। এছাড়া একই ইউনিয়নের জোটন প্রধান নামের এক যুবকও নিহত হন। ওই সহিংসতায় আহত হয়েছিল কয়েক শ’ লোকজন। এই ঘটনার পরিকল্পনা তারই ছিল বলে নূর হোসেন স্বীকার করেন।
 
এদিকে কলকাতায় থাকার সময় নূর হোসেনের সঙ্গে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মিরপুরের কিলার সাহাদাত ও জামিল, মগবাজারের মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন দেখা করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। ভারতে থাকাকালে টাকার কোন সমস্যা হয়নি বলেও জানান তিনি। বাংলাদেশ থেকে তাকে নিয়মিত টাকা পাঠানো হতো বলে জানান নূর হোসেন।
 
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে নূর হোসেনকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছে হস্তান্তর করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। পরে র?্যাব প্রহরায় তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। আসার পথে মাগুরায় র্যাবের বহরের একটি গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। ঢাকায় এনে প্রথমে উত্তরায় র্যাব-১ এর কার্যালয়ে নূর হোসেনকে রাখা হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তাকে সাত খুন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেখান থেকে তাকে পুলিশ প্রহরায় নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইন্সে নেয়া হয়। সেখানে পুলিশ নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
 
বেনাপোল থেকে আসার পথে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান গল্পের ছলে নূর হোসেনকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করেন। নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইন্সে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মুহিদ উদ্দিন ও তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মামুনুর রশিদ মণ্ডল।
 
জিজ্ঞাসাবাদে নূর হোসেন জানিয়েছেন, ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামিরা যেসব কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো সঠিক।
 
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৭ এপ্রিল সাত খুনের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার একদিন পরে ভারতে পালিয়ে যান নূর হোসেন। ওই বছরেরই ১৪ জুন কলকাতার বাগুইআটিতে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। তার বিরুদ্ধে সে দেশে অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা হয়। গত মাসে ভারত সরকার সেই মামলা প্রত্যাহার করে নিলে নূর হোসেনের দেশে ফেরার পথ সুগম হয়।

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top