বিনা বিচারে বন্দীদের কান্না শুনতে পায় না কেউ কাশিমপুর কারাগারেই আটক ৩৪ জন

S M Ashraful Azom
সেবা ডেস্ক:  মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের বাবুল ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হন। এরপর থেকে তিনি কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে দেড় যুগ ধরে বন্দী রয়েছেন। শুধু বাবুলই নন, হত্যা-ধর্ষণসহ গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের ঘটনায় দায়েরকৃত বিভিন্ন মামলায় ৩৪ বন্দী বিনা বিচারে দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আটক রয়েছেন। এদের প্রত্যেককে প্রায় অর্ধ শতবার বিচারিক আদালতে হাজির করা হয়েছে। কিন্তু জামিন মেলেনি। শেষ হয়নি মামলার বিচার কার্যক্রমও। ফলে বিনা বিচারে তাদের কারাগারেই আটক থাকতে হচ্ছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে বিনা বিচারে কারাগারে আটক থাকা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এসব বন্দীদের কান্না কেউ শুনতে পায় না। কেন এসব মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের খোঁজ নেয়া উচিত। যদি কারো দায়িত্বে অবহেলার কারণে কোনো মামলার বিচার ঝুলে থাকে তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
 
গত ২৬ জুন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার পরিদর্শনে যান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরিদর্শনকালে তিনি কারাগারে বিনা বিচারে আটক বন্দীদের বিষয়ে তথ্য জানতে চান। কারা কর্তৃপক্ষ প্রধান বিচারপতিকে জানান, মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিনা বিচারে কারাগারে অনেক বন্দী রয়েছেন। পরে কাশিমপুর কারা কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন বিনা বিচারে আটক বন্দীদের ৩৪ জনের একটি তালিকা সংবলিত প্রতিবেদন সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়। এতে বলা হয়, তালিকার বন্দীরা পাঁচ বছর বা তদূর্ধ্ব সময় মামলা অনিষ্পন্ন থাকায় কাশিমপুর কারাগারে আটক  রয়েছেন।
 
ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজধানীর ডেমরা থানার একটি মামলায় ১৯৯৯ সাল থেকে কারাগারে বন্দী আছেন লৌহজংয়ের বাবুল। ৯৮ সালে দায়েরকৃত মামলাটি ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এই মামলায় বাবুলকে ৫৪ বার আদালতে হাজির করা হয়েছে। এছাড়া কেরানীগঞ্জের ইমানদীপুরের বাসিন্দা রাজিব হোসেন খিলগাঁও থানার মামলায় ২০০৩ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে, একই বছরের ১১ ডিসেম্বর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুরের টঙ্গী বোর্ডবাজারের বাবু, রাজধানীর কোতোয়ালি থানার মামলায় কেরানীগঞ্জের শুভাড্যার জাকির হোসেন টুটুল ২০০৪ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে, একই থানার মামলায় ওই বছরের ২ জুলাই থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. পারভেজ, খিলগাও থানার মামলায় কুমিল্লার হোমনার গোয়ালিয়ারচরের আনোয়ার হোসেন ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর থেকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে আটক রয়েছেন। ২০০৫ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে উত্তরা থানার মামলায় নেত্রকোনার কমলাকান্দা চেংগিনি ইউনিয়নের লিটন, বাড্ডার আদর্শনগরের সাইদুর রহমান একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে, পল্লবী থানার মামলায় ময়মনসিংহের তারাকান্দার রতন মিয়া ২০০৬ সালের ২০ এপ্রিল থেকে আটক রয়েছেন কারাগারে। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে হাজারীবাগ থানার মামলায় কুমিল্লার হোমনার মোবারক ও মো. সেলিম, তেজগাঁও থানার মামলায় একই বছরের ১৪ এপ্রিল থেকে ঝালকাঠি সদরের সোহেল, কাফরুল থানার মামলায় ওই বছরের ১৬ আগস্ট থেকে গোপালগঞ্জ সদরের শেখ মান্নান, কেরানীগঞ্জ থানার মামলায় নজরুল ইসলাম ১৩ মার্চ থেকে আটক রয়েছেন।
 
২০০৮ সালের ১১ জুন থেকে ধানমন্ডি থানার মামলায় লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের জাকির হোসেন, সবুজবাগ থানার মামলায় ওই বছরের ২২ মার্চ থেকে কারাগারে আছেন ভোলার দৌলতপুরের আবুল হোসেন, ডেমরার মামলায় ঢাকার নড়াইবাগের রাসেল ২০ সেপ্টেম্বর থেকে, ফেনীর সেলিম ওই বছরের ১২ এপ্রিল থেকে, লালবাগ থানার মামলায় সিরাজগঞ্জ সদরের সুমন ৭ জানুয়ারি থেকে এবং বাড্ডা থানার মামলায় একই বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে কারাগারে আছেন কুমিল্লার হোমনার আব্দুস সাত্তার।
 
২০০৯ সাল থেকে কারাগারে আটক আছেন নয়জন বন্দী। এদের মধ্যে কদমতলী থানার মামলায় মুন্সিগঞ্জ সদরের নজরুল ইসলাম ২০০৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে, দোহার থানার মামলায় ওই থানার অধিবাসী লাভলু ১০ ডিসেম্বর থেকে, খিলগাঁওয়ের মামলায় কুমিল্লার হোমনার বাবু ওরফে তোরা বাবু ১০ জানুয়ারি থেকে, ১২ জুন থেকে আদাবরের অস্ত্র মামলায় চাঁদপুরের হাইমচরের আল আমিন, উত্তরা মডেল থানার মামলায় বগুড়ার শফিকুল ইসলাম ৮ আগস্ট থেকে, কাফরুল থানার মামলায় বরিশালের গৌরনদীর পারভেজ সাদ্দাম ১৬ অক্টোবর থেকে, মতিঝিল থানার মামলায় নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির আবুল বাশার ১৩ জুন থেকে, মোহাম্মদপুরের মামলায় সুনামগঞ্জের শ্রিনগরের আ. রাজ্জাক ওরফে কুদ্দুস ১৭ অক্টোবর থেকে এবং আশুলিয়া থানার মামলায় পাবনার চাটমোহরের আ. খালেক ১৬ আগস্ট থেকে কারাগারে রয়েছেন।
 
২০১০ সাল থেকে কারাগারে আছেন পাঁচ জন। এদের মধ্যে আশুলিয়ার মামলায় ওই বছরের ৮ অক্টোবর থেকে কুমিল্লার দাউদকান্দির আবুল বাশার, কাফরুলের মামলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহজালাল ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে, সবুজবাগ থানার মামলায় বি. বাড়িয়ার শাহীন ৩১ অক্টোবর থেকে, ৩ জানুয়ারি থেকে আদাবরের মামলায় ঝালকাঠির নলছিটির খোকন ওরফে বাবু, দক্ষিণখান থানার মামলায় গাজীপুরের কালিয়াকৈরের জসিমউদ্দিন ২৪ অক্টোবর থেকে কারাবন্দী রয়েছেন।
 
এদিকে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক বন্দীদের তালিকা চেয়ে সম্প্রতি দেশের সকল কারাগারে চিঠি পাঠিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড কমিটি। পাঁচ ও দশ বছরের অধিক সময় ধরে যারা আটক রয়েছেন তাদের বিষয়ে দুটি তালিকা প্রস্তুত করে কমিটির কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের সকল কারাগারে এই চিঠি পাঠায় লিগ্যাল এইড কমিটি। এতে বলা হয়, নিম্ন আদালতে বিচারের জন্য প্রস্তুত হওয়া মামলাসমূহ সাক্ষ্যগ্রহণসহ নানাবিধ কারণে দীর্ঘ সময় ধরে অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে থাকে। ফলে কার্যত সাজা হওয়ার পূর্বেই আটক বন্দী দীর্ঘদিন ধরে কারাভোগ করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে মামলায় যে দণ্ড হতো তার চেয়েও বেশি সময় কারাভোগ করছেন বিচারাধীন বন্দীরা।
 
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বার কাউন্সিল ফাইন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শম রেজাউল করিম বলেন, যে কোনো নাগরিকেরই সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে আইনানুযায়ী রাষ্ট্র থেকে আচরণ বা ব্যবহার পাওয়ার। বিনা বিচারে অর্থাত্ দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পূর্বেই জেল হাজতে আটক রাখা সম্পূর্ণরূপে আইনের শাসনের পরিপন্থী এবং নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার শামিল। এই বিনা বিচারে আটকের ঘটনা প্রমাণ করেছে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের প্রতি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছে না। সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সাংবিধানিক অধিকার বাস্তবায়নে একটি সাহসী পদক্ষেপ। তিনি বলেন, বিচার ছাড়াই দীর্ঘদিন জেল হাজতে আটক থাকা শুধু সাংবিধানিকই নয় মানবাধিকার লংঘনেরও শামিল। তাদের এই হাজতবাস কখনোই রাষ্ট্র ফেরত দিতে পারবে না; পারবে না এর ক্ষতিপূরণ দিতেও। যদি তারা নির্দোষ প্রমাণিত হন। সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আরো বেশি সংবেদনশীল ও নাগরিকের জন্য দায়িত্ববান হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
 

চার নারী বন্দীকে আদালতে হাজিরার নির্দেশ

 
পৃথক চারটি হত্যা মামলায় গাজীপুরের কাশিমপুরের মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিনা বিচারে আটক চার নারী বন্দীকে আগামী ১৬ জানুয়ারি আদালতে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এ ছাড়া তাদের কেন জামিন দেওয়া হবে না এই মর্মে রুল জারি করেছে আদালত। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি জে বি এম হাসানের ডিভিশন বেঞ্চ গতকাল বুধবার সকালে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই আদেশ দেন। একই সঙ্গে এসব হত্যা মামলার নথি আদালতে তলব করা হয়েছে।
 
চারটি হত্যা মামলায় নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের শাহনাজ বেগম ২০০৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, একই জেলার সুমি আক্তার রেশমা ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি এবং ওই বছরের ২১ মে গাজীপুরের রাজিয়া সুলতানা ও ২১ নভেম্বর ময়মনসিংহের রাণী ওরফে নূপুর কারাগারে যান। এরপর থেকে এসব মামলায় তাদেরকে ৫০-৭৬ বার আদালতে হাজির করা হয়েছে। কিন্তু আজ অবধি এসব মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়নি। বিচার শেষ না হওয়ায় প্রায় আট বছর ধরে তারা কারাগারে বিনা বিচারে বন্দী রয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড কমিটির নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এই চার বন্দীর বিনা বিচারে আটক থাকার তথ্য আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা। তিনি বলেন, নিজস্ব আইনজীবী না থাকায় তারা বিনা বিচারে কারাগারে আটক রয়েছেন। এ পর্যায়ে আদালত বলেন, উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত সঠিক কিনা? আইনজীবী বলেন, তথ্য-উপাত্ত সঠিক আছে। শুনানি শেষে হাইকোর্ট উপরোক্ত আদেশ দেন।
 
প্রসঙ্গত বিনা বিচারে দীর্ঘদিন যারা কারাগারে আটক তাদের মধ্য থেকে সম্প্রতি মো. সিপন নামে এক ব্যক্তি উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এছাড়া আরো চার ব্যক্তিকে কেন জামিন দেওয়া হবে না এই মর্মে রুল জারি করেছে আদালত।
 
ইত্তেফাক

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top