শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ভবনে একদিন

S M Ashraful Azom
শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ভবনে একদিন
সেবা ডেস্ক: বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২৫ মে শুক্রবার একত্রে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন করেন। দুই দেশের বন্ধুত্বের আরেকটি নিদর্শন বলে মনে করা হচ্ছে একে । এই ভবনে বাংলাদেশের ইতিহাস, নানা নিদর্শন, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তুলে ধরেছে শান্তিনিকেতনে নির্মিত বাংলাদেশ ভবন।

২৫ মে শুক্রবার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে ভবনটির উদ্বোধন করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, আমরা এখানে এবং দেশের যে কোনো স্থানে শিক্ষার্থীদের সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশ এবং ভারতের উষ্ণ সম্পর্কের প্রতীক হিসেবে ২৫ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ ভবন। এসময় সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন।

অত্যাধুনিক দোতলা এই ভবনটিতে আছে একটি মিলনায়তন, জাদুঘর এবং গ্রন্থাগার। প্রায় ৪৬ হাজার বর্গফুট জায়গার এই ভবনে উদ্বোধনের আগের রাত পর্যন্তও কাজে ব্যস্ত ছিলেন বাংলাদেশ থেকে আসা শিল্পী আর কর্মীরা। জাদুঘরটি চালু হচ্ছে প্রায় ৪ হাজার বর্গফুট এলাকা নিয়ে। পরে এটাকে আরও বড় করার পরিকল্পনা রয়েছে। গ্রন্থাগারের জন্য বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৫শ বই। এর মধ্যে অনেক বই রবীন্দ্রচর্চা এবং রবীন্দ্র গবেষণা ভিত্তিক, যা ভারতে সহজলভ্য নয়। বাংলাদেশ ভবনে ছাপানো বই ছাড়াও ডিজিটাল বইও পড়তে পারবেন পাঠকরা।

বাংলাদেশ ভবনের জমির পরিমাণ ৮ বিঘা সমপরিমাণ বা প্রায় ২.৭৫ একর। ভবনে রয়েছে ৪৫৩ আসনবিশিষ্ট একটি আধুনিক অডিটোরিয়াম, দু’টি সেমিনার হল, গ্রন্থাগার, জাদুঘর, ক্যাফেটেরিয়া ও আর্কাইভ স্টুডিও। অডিটোরিয়ামটিতে আলো এবং শব্দের যথাযথ প্রক্ষেপণের দারুণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অডিটোরিয়ামের ছাদ তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের নৌকার ছৈ-এর আদলে। ভবনের নিচ তলায় দু’টি সেমিনার হল রয়েছে যার প্রত্যেকটি ১৬০ আসন বিশিষ্ট। প্রয়োজনে সেমিনার হল দু’টির অন্তর্বর্তী স্লাইডিং ফোল্ডিং পার্টিশন সরিয়ে একটি মাল্টিপারপাস হল হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। ভবনের নিচতলায় দক্ষিণ পার্শ্বে প্রায় ৩০০০ বর্গফুট জয়াগাজুড়ে একটি জাদুঘর আছে। এখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কিত বিষয়াদি প্রদর্শনীর জন্য স্থান পাবে।

তারিক সুজাত বলেন, ‘১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় থেকে শুরু করে পরের বিভাগ শুরু হয়েছে ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক যে বিভাগ, তার আগে ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গটি এ কারণে রাখা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সূচনা তো সেই ৫২ সাল থেকেই’।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেমন রয়েছে, তেমনই আছে অতি দুর্লভ কিছু ছবি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত নানা প্রত্ন নিদর্শনের অনুকৃতি। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির মধ্যে উয়ারি বটেশ্বরে প্রাপ্ত প্রত্ন নিদর্শন যেমন আছে, তেমনই আছে ৬ষ্ঠ-৭ম শতকের পোড়ামাটির কাজ, ১৬শ শতকের নক্সাখচিত ইট প্রভৃতি। রয়েছে পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়ের নানা নিদর্শন, দেবদেবীদের মূর্তি। কোনটা পোড়ামাটির, কোনটি ধাতব। মাঝখানে সুলতানি এবং ব্রিটিশ শাসনামলও এসেছে জাদুঘরটিতে রাখা নানা প্যানেলে। রয়েছে ঢাকার জাতীয় জাদুঘর থেকে আনা বেশ কিছু মুদ্রা। ভবনটির কিউরেটর তারিক সুজাত জানান, জাদুঘরটিকে মূলত ৪টি জোনে ভাগ করা হয়েছে। শুরু হয়েছে উয়ারি বটেশ্বরে প্রাপ্ত ২ হাজার ৫শ বছরের পুরনো সভ্যতার নিদর্শন দিয়ে, শেষ হয়েছে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে। মাঝের অনেকটা সময় জুড়ে এসেছে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ।

নিচতলায় প্রবেশের পরে ভবনের ভেতরে একটি উঠান আছে। উঠানে প্রাকৃতিক আলো আসার ব্যবস্থা রয়েছে এবং বর্ষাকালে ওই উঠানে বসে বর্ষার শব্দ ও আমেজ উপভোগ যাবে। বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রচারের জন্য এই উঠানে কোনো মেলার আয়োজন হতে পারে বা একটি মিলনমেলার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। লাইব্রেরিটি ভবনের দোতলায় প্রায় ১৩০০ বর্গফুট জায়গাজুড়ে। এছাড়াও একটি স্টুডিও ও একটি ফ্যাকাল্টি কক্ষের সংস্থান রয়েছে দোতলায়।দোতলার বামপার্শ্বে প্রায় ১০০০ বর্গফুটের একটি ক্যাফে আছে। ক্যাফের বাইরে খোলা ছাদে বসার ব্যবস্থা রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রয়েছে একটি আলাদা গ্যালারি। তাতে দেখা যাচ্ছে যুদ্ধের সময়কার নানা দুর্লভ ছবি, শরণার্থী শিবির এবং অন্যান্য ছবি। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে রয়েছে সম্পূর্ণ পৃথক একটি বিভাগ। পূর্ববঙ্গে সাজাদপুর, শিলাইদহ, পতিসরের কাছারীবাড়ির ছবি, সেখানে কবির ব্যবহৃত নানা জিনিষের অনুকৃতি দিয়ে সাজানো রয়েছে জাদুঘরের এই অংশটি। পুরো ভবনটি প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রবেশগম্য হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে। ভবনে ব্যবহৃত উপকরণসমূহে মাটি পোড়ানো ইট ব্যবহার না করে স্যান্ড সিমেন্ট দ্বারা তৈরি ইট ব্যবহার করা হয়েছে এবং চৌচালা ছাদে ইটের টালির পরিবর্তে পিভিসি লাল টালি ব্যবহার করা হয়েছে।

স্থাপত্যশৈলী আর ঐতিহ্যে বাংলাদেশ ভবন এক আদর্শ নিদর্শন। শুধু জ্ঞান চর্চাই নয়, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং সম্প্রীতির মেলবন্ধন সঞ্চারে বাংলাদেশ ভবন প্রতীক হয়ে উঠবে বলে আশা প্রকাশ করেন সবাই।



ট্যাগস

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top