লোক দেখানো ইবাদত আল্লাহ গ্রহন করবেন না

S M Ashraful Azom
0
লোক দেখানো ইবাদত আল্লাহ গ্রহন করবেন না
সেবা ডেস্ক: হজরত জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ (রাদি.) থেকে বর্ণিত হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো কাজ নিজ খ্যাতি লাভের জন্য করবে, আল্লাহ তায়ালা তার বদনাম রটিয়ে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানো কোনো নেক কাজ করেন, আল্লাহ তায়ালা মানুষের নিকট তা প্রকাশ করে দেন।’

উল্লেখ্য হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি বিষয়ের প্রতি গুরত্ব দিয়েছেন। (এক) রিয়া বা লৌকিকতা। (দুই) খ্যাতি বা প্রসিদ্ধিলাভ।

প্রত্যেক ভালো কাজ আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করা হলো ইখলাস। আর আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির বিপরিত করাটাই রিয়া। ইখলাস হলো, সমস্ত আমলের রুহ, ইখলাসবিহীন কোনো আমল আল্লাহ তায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। রিয়া বা লৌকিকতা সকল আমলকে বরবাদ করে দেয়।

মানুষ দেখানোর জন্য যা কিছু করা হয়, তাকে রিয়া বলে। অর্থাৎ, মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্যতা লাভের জন্য কোনো ইবাদত লোকদের দিখিয়ে করা। মানুষকে দেখানো দান সদকা, নামাজ, রোজা বা অন্যান্য ইবাদত করা। যাতে লোকেরা তাকে ভালো মনে করে। বা সমাজে তাকে মানুষ সম্মান করে।

রিয়া এর প্রথম ধাপ: মানুষের অবস্থা ভেবে রিয়া বিভিন্নভাবে বিভক্ত। রিয়া কখনো কুফর/শিরিক পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। কখনো এর চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের হয়ে থাকে। সব চেয়ে মারাত্মক রিয়া হলো, ঈমানের মধ্যে যা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, দিলের ঈমান নেই অথচ মানুষের নিকট নিজেকে অনেক বড় ইবাদতকারী সব্যস্ত করানো, নিজেকে খাঁটি মুসলমান হিসেবে ব্যবহার করা। এটা মুনাফিকের কাজ। কোরআনে বলা হয়েছে, মুনাফিকরা জাহান্নামের সবচেয়ে নিম্ন স্থানে অবস্থান করবে। তথা কঠিন আযাবে নিপতিত হবেন।

রিয়া এর দ্বিতীয় ধাপ: রিয়া এর দ্বিতীয় স্তর হলো, ফরজ ইবাদতের ক্ষেত্রে রিয়া করা। যেমন, কোনো মানুসের নামাজ পড়ার অভ্যাস নেই। কিন্তু কোনো জায়গায় মানুষের নিকট অপমানিত হবে, এই ভয়ে নামাজ আদায় করা। যদিও এটা স্পষ্ট শিরক নয়। তথাপি সুফিয়ানে কেরামের নিকট এটাও শিরিক। কেননা সে মাখলুকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য নামাজ আদায় করেছে। হ্যাঁ, সে যদি এর পর থেকে নিয়মিত নামজ আদায় করে তাহলে তার এই কাজকে রিয়া বলা হবে না।

রিয়া এর তৃতীয় ধাপ: কোনো ব্যক্তি নফল ইবাদতে অভ্যস্ত নয়, কোনো এমন জায়গায়, আসল, যেখান থেকে যাওয়ার ইচ্ছা সত্তেও সুযোগ পাচ্ছিল না। আর অন্যান্য ব্যক্তিরাও নফল নামাজ পড়তেছে, তখন সে তাদেরকে দেখানোর উদ্দেশ্যে নফল আদায় করা শুরু করে দিল। মনে করল, আমি এখন নফল আদায় না করলে লোকেরা আমাকে খারাপ মনে করবে। তার এই কাজটা রিয় এর তৃতীয় স্তর।
এমনিভাবে মানুষদেরকে দেখানোর নিয়তে সুন্দর করে নামাজ আদায় করা, বিনয়ীতার সঙ্গে নামাজ আদায় করা। লম্বা কেরাত পড়া, রুকু-সেজদায় অনেক দেরি করা। সবই রিয়া এর অন্তর্ভূক্ত। এসব থেকে পরিত্রান পেতে হলে ভালো শায়েখের নিকট নিকট নিজের এই অবস্থার কথা জানাবে। আর রিয়া শুধু নামজ, রোজার সঙ্গেই খাছ নয় বরং এটা যে কোনো ইবাদতের ক্ষেত্রেই হতে পারে।

রিয়ায়ে খফি: কোনো ব্যক্তি গোপনে ইবাদত করছিল, হঠাৎ কেউ এসে তা দেখে তার প্রশংসা শুরু করে দিল। তার জন্য দোয়া করতে লাগল, এত ইবদাতকারী ব্যক্তি আনন্দিত হলো। এটাকে সুফিয়ানে কেরামের ভাষায় রিয়ায়ে খফি বলা হয়।

এক সাহাবির ঘটনা: একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কখনো খুব ইখলাছের সঙ্গে ইবাদত করতে থাকি, পরবর্তীতে কারো মুখে আমার ইবাদতের প্রশংসা শুনে আমি আত্মতৃপ্তি বোধ করি। এটা কেমন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা তো মুমিনের জন্য সুসংবাদ।
যেহেতু এই আমল আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্যই করা হয়েছে। তাই তিনি দুনিয়াতে তার বান্দার খোশ খবর তার বান্দাদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এ আমল আল্লাহ তায়ালা কবুল করেছেন তাই এটা রিয়া নয়।

এক বুযুর্গের ঘটনা: হজরত মুফতি শফি (রহ.) বলেন, এক বুযুর্গ এমন ছিলেন, যে, তার মজলিসে মানুষের সমাগম হত। তার ওয়াজ নসিহত শুনে মানুষ প্রশংসা করতে থাকতো। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনার মুখের ওপর প্রশংসা হচ্ছে, তাতে আপনি খুশি হচ্ছেন? বুযুর্গ বললেন, আমি মূলত তাদের প্রশংসায় খুশি নই। বরং আমার খুশি হওয়ার কারণ হলো, আমার মত মানুষের জন্য আল্লাহ তায়ালা কতইনা রহম করে তাদের দিলে আমার প্রশংসা করার খেয়াল ঢেলে দিলেন। এজন্যই আমি প্রশংসা শুনে খুশি হয়ে থাকি।

রিয়া এর ব্যাপারে রাসূল (সা.) এর হুঁশিয়ারি: রিয়াকারীদের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য নামাজ আদায় করল, সে মাখলুককে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করল। অতএব, এই রিয়া থেকে আমাদেরকে বাঁচতে হবে। এর থেকে প্রতিকার পেতে হলে সর্বপ্রথম আল্লাহর কাছে পানা চাইতে হবে। এর পর কোনা আল্লাহ ওয়ালার নিকট নিজেকে সপে দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালার প্রতি মহাব্বত বাড়িয়ে দিতে হবে। তখন দিলের মধ্যে আর রিয়া স্থান পাবে না।

মানছুর হাল্লাজের কাহিনী: মানছুর হাল্লাজ নামক একজন বড় ছুফি ছিলেন, একবার তিনি انا الحق‘আমি হক’ বললেন তারপর দুনিয়াতে তার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেল। মূলত তার ওই কথা দ্বারা তিনি নিজেকে খোদা দাবি করেননি। বরং উদ্দেশ্য ছিল গোটা সৃষ্টিকূলে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি নিজের স্থানে নিজে সঠিক ছিলেন, তবে তৎকালিন উলামায়ে কেরামগনের ফতোয়া মোতাবেক তাকে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে কতল করতে চাইল, সেই মজলিসে জুনায়েদ বুগদাদি উপস্থিত ছিলেন, মানছুর তাকে দেখে বললেন, আপনিই বলুন, যারা আজ আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া প্রদান করেছেন আমি কী তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেছি? আপনি জেনে শুনে কীভাবে এই মজলিসে আসলেন? জুনায়েদ বোগদাদি (রাহ.) বললেন, বাস্তবতা যাই হউক না কেন, হুকুম তাই যা ওলামায়ে কেরাম বলেছেন। এজন্য আমি এই ফতোয়া দিয়েছি।

আল্লাহ তায়ালার মুহাব্বত সৃষ্টির পদ্ধতি: হজরত থানুবি (রহ.) বলেন, আল্লাহ তায়ালার মুহাব্বত দিলে পয়দা করতে হলে, আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতসমুহের কথা ভাবতে থাক। তোমাকে আল্লাহ তায়ালা কী কী নেয়ামত দান করেছেন? এর জন্য তোমাকে কোনো প্ররিশ্রম করতে হয়নি, কোনো টাকা-পয়সা ব্যয় করতে হয়নি। তাই আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত সমুহকে নিয়ে চিন্তা-ফিকির করা উচিত। যিনি আমাকে বিনামুল্যে এত কিছু দান করেছেন তিনি আমার থেকে ইবাদত/মুহাব্বত পাওয়ার উপযুক্ত নন। তিনি কত মেহেরবান, কত দয়ালু। এত করে দিলের মধ্যে প্রশান্তি সৃষ্টি হবে।  আল্লাহ তায়ালার মুহাব্বত দিলের মাঝে না থাকার কারণেই আত্মার ব্যাধীগুলো সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা যদি আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতসমুহ গননা করতে চাও, তবে তা গননা করে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয়ই মানুষ অত্যন্ত যালেম। তাই আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত সমুহের কথা চিন্তা কর, সব ধরনের দুখ কষ্ট দুর হয়ে যাবে।

বুযুর্গদের দৃষ্টি নেয়ামত সমুহের দিকে: মুফতি শফি (রহ.) এর উস্তাদ সাইয়্যেদ হোসাইন (রহ.) যিনি মিয়া সাহেব নামে খ্যাত ছিলেন, একবার তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন, শফী সাহেব তাকে দেখতে গেলেন, তার শরিরে অনেক জ্বর দেখতে পেলেন। সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার এখন কেমন লাগছে? মিয়া সাহেব (রহ.) বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, আমার চোখ, কান, নাক সব সুস্থ। কোনো ধরনের সমস্যা নেই। কেবল একটু জ্বর আছে। এটাও ইনশাআল্লাহ চলে যাবে। দেখুন, অসুস্থ অবস্থায় আল্লাহর নেয়াতের ওপর কতটুকু খেয়াল রেখেছে।

কষ্টের তুলনায় নেয়ামত বেশি রয়েছে: মুফতি শফী (রহ.) একবার ঘরে বসে কথা বলছিলেন, কথার মাঝে দাঁত সম্পর্কে বললেন, বাচ্চাদের দাঁত উঠার সময় অনকটা কষ্ট হয়, তা শুনে ঘর থেকে মহিলা এসে বলল, হ্যাঁ, এই দাঁত বড় আশ্চর্য্য উঠতেও কষ্ট দেয় আবার পড়তেও কষ্ট দেয়। একথা শুনে আমার পিতা বললেন, এই আল্লাহর বান্দি, তুমি দাঁতের ব্যাপারে এই দুটি কথাই বললে, অথচ এই দাঁত তোমার কত উপকার করেছে। কত কিছু এর দ্বারা তুমি চিবিয়ে খেয়েছো।

বুর্যুর্গদের এসকল আমলা দ্বারাও বুঝে আসে তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসা থেকে সকল আমল করেছেন। কোনো ধরণের লৌকিকতা করেননি। নিজেদের ইসলাসের সঙ্গে সকল আমলের সঙ্গে জড়িত রেখেছেন। কোনো ধরণের রিয়া মনে এলেই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। আল্লাহ আমাদেরকেও একই পথে চলার তাওফিক দিন। আমিন।

⇘সংবাদদাতা: সেবা ডেস্ক
ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top