আপাতত বিদায় ‘রাজকাহন’ থেকে নবনীতা চৌধুরী

S M Ashraful Azom
0
আপাতত বিদায় ‘রাজকাহন’ থেকে নবনীতা চৌধুরী
সেবা ডেস্ক:  ‘রাজকাহন’-এ আমার শেষ দিন ছিল বৃহস্পতিবার (২৭ জুন)। প্রায় ২ বছর সাড়ে ৯ মাস টানা সপ্তাহে ৫ দিন দুই ঘণ্টা ধরে প্রশ্ন তোলা, রাজনীতি খোঁজা আর উত্তর মেলানোর চেষ্টায় বিরতি এখন থেকে।  আমার জীবনের সেরা সময় কাটালাম প্রতিদিন আপনাদের সাথে। একদিনও মনে হয়নি ক্লান্তি এসেছে বা প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।  প্রতিদিন একই উৎসাহে ভালোবাসার কাজ করার সুযোগ পাওয়া বড় সৌভাগ্যের।

এরচেয়েও বড় ভাগ্য, যখন নিজের ভালোবাসার কাজটা করে দেশের খ্যাতনামা মানুষ থেকে একদম সাধারণ মানুষ-রিকশাওয়ালা বা ফেরিওয়ালার ভালোবাসা পাওয়া যায়, সেই সৌভাগ্যও আমার হয়েছে। আমার অনুষ্ঠানের ( রাজকাহন নামটা যখন ঠিক করলাম,সবাই বললেন খটমট নাম মানুষের মাথায় ঢুকবে না!) বা আমার অপ্রচলিত নাম স্পষ্ট উচ্চারণ করতে দেখেছি সাধারণ– অসাধারণকে। আমরা এ দেশের গণমাধ্যমের মানুষই যখন বলে বেড়াচ্ছি আমাদের টিভি কেউ দেখে না তখন ঝকঝকে তরুণ দম্পতি কিংবা কোনও বৃদ্ধযুগল ছবি তুলে বলেছেন দুজনে মিলে রাজকাহন দেখা তাদের যৌথ আনন্দ;লালবাগ মাদ্রাসার একদল ছাত্র সেলফি তুলতে ঘিরে ধরে পরম তৃপ্তি নিয়ে বলেছেন, মোবাইলে এমবি কিনে দেখা রাজকাহন তাদের দেশ-দুনিয়া জানার এক প্রিয় জানালা; কিংবা কোন বাবা ছেলেমেয়ের ছবি দেখিয়েছেন, পাঠিয়েছেন, দোয়া করতে বলেছেন ছেলেমেয়েরা যেন আমার মতো হয়! এক বাবা মেয়ের নামই রেখেছেন আমার নামে! নিজে মেয়ের মা হয়ে জানি এমন চাওয়ায় কত গভীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা থাকে! দেশের এক সর্বজন শ্রদ্ধেয় আইনজীবী, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর রাজকাহনের নিয়মিত দর্শক হিসেবে অনেক বিশিষ্টজনকে আমার অকপট প্রশ্নের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, তাঁর চোখে আমিই নাকি বাংলাদেশের ন্যায়পাল! আহা.... ‘আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি’!

কিন্তু, প্রতিদিন এই কম্পিউটারে বিশ্ব দেখে স্টুডিওতে আলাপ তুলে আমার সাংবাদিকতার ক্ষুধা মিটছে না। প্রায় দু-দশক আগে একুশে টেলিভিশনে সাংবাদিকতার সূত্রে যখন সদ্য কৈশোর পেরোনো আমি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, ঢালচর আর চর কুকড়ি মুকড়ি থেকে সুন্দরবন চষে বেড়িয়েছি, তখনও সারাদেশে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, বিদ্যুৎ তো নেই-ই। এখন কী সত্যিই সুদূর পাহাড়ে ইন্টারনেটে সংযুক্ত হয়ে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম পূরণ করছে? নাকি এসবই বিজ্ঞাপনের ভ্রম? ঢাকায় বসে টকশোর টেবিল গরম করে আমরা যারা ভাবছি আমরাই পুরো দেশের মতামত তুলে ধরছি,আলোচ্যের গতিপথ নির্ধারণ করছি-স্যাটেলাইট টিভিতে ভর করে আমরা কী দুই দশক আগের সেই একমাত্র বেসরকারি টেরিস্ট্রিয়াল চ্যানেল একুশে টিভির মতো তৃণমূলের সাধারণ মানুষের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পেরেছি? মনে আছে, নিকলির দুর্গম হাওড় এলাকায় নৌকা করে ক্যামেরা ছাড়াই যখন আমি ঘুরছি গণমানুষের গল্পের খোঁজে, তখন তা জেনে সে নৌকা ঘাটে দাঁড় করিয়ে, সেচের ব্যাটারি লাগিয়ে যে টিভির তৃণমূলের অনুষ্ঠান ‘দেশজুড়ে’ তারা দেখতেন, এবার সেই অনুষ্ঠানে তাদের সংগ্রাম আর সাফল্যের গল্প উঠে আসবে জেনে, পারে ঘুঁটে দেওয়া বাদ দিয়ে সারি ধরে মহিলারা দাঁড়িয়ে গিয়ে, কী পরম ভালোবাসা দেখিয়েছিলেন ওই টিভির পর্দার পেছনের এই অপরিচিত কর্মীকে। আমরা কি আদৌ আর বলছি তাদের কথা?

দুই দশক আগের যে বাংলাদেশের কথা আমি বলছি সে সময় সরকারি বেসরকারি সব চেষ্টা চলছে মেয়েদের শিক্ষা প্রসারে, মেয়েদের কাজে বের করে আনতে। ভাবনাটা ছিল মেয়েরা রোজগার করবেন, নিজের পায়ে দাঁড়াবেন আর তাদের ঘরে বাইরে মার খাওয়া, খুন হওয়া বন্ধ হবে। মেয়েরা ঘর থেকে দলে দলে বেরুলেন,কাঁথা সেলাই করে সংসার সামাল দেওয়া থেকে যুদ্ধবিমান চালানো শুরু করলেন-কিন্তু ঘরে বাইরে তার মার খাওয়া,মরতে থাকা কমলো না কেন? আমরা যখন কোনও পোশাকে মেয়েরা বেরিয়ে এলেন তা নিয়ে তর্কে মাতি তখন ঢাকার রাজপথে, গণপরিবহনে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর সংখ্যা সকল প্রতিকূলতা দলে কত বেড়েছে তার হিসাব রাখি? দুই দশক আগের ঢাকা শহরে যখন হুড ফেলে একা মেয়ে রিকশায় চড়লে আমাদের বিরাট বেপরোয়া ভাবা হতো, সেই শহরে মেয়েরা কোন পরিবার আর সমাজের শক্তিতে বাইক দাপড়ে বেড়াচ্ছেন? সমাজে কী তবে শুধুই নুসরাত আর তনুই সত্য নাকি পরিবার,সমাজ,রাষ্ট্র হাঁটছে সমতা বিধান আর ন্যায্যতার পক্ষেই? তাহলে সেই সমাজ কেন রুখে দাঁড়াতে পারে না ঘরে, রাজপথে, গণপরিবহনে নারীর নির্যাতন? আসলে পুরুষ তার একরকম একক দখলে থাকা কাজের জায়গা, রাস্তা বা সাফল্যে নারীর এই পালে পালে ঢুকে পড়ার বিষয়টা কীভাবে নেবে,নারী-পুরুষের ক্ষমতা কাঠামো কীভাবে বদলাবে তা কী ছিল এতদিন আমাদের ভাবনায়? কিন্তু তারপরেও দেশটায় কী শুধুই ওসি মোয়াজ্জেম আর সেই ম্যাজিস্ট্রেটই আছেন, যারা নুসরাত নিরাপত্তা চাইতে গেলে উল্টো তাকে ভয় দেখান, নাকি সেই উপজেলা কর্মকর্তাও আছেন, যিনি মাইলের পর মাইল হেঁটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করেন? আছেন তো নুসরাতের সেই তরুণ ভাইটিও, যিনি বোনের ওপর অন্যায়ের বিচার চাইতে একদিনও বিরতি নেননি।

দেশটা কি শুধুই খেলাপি আর দুর্নীতিবাজে ভরে গেছে? তারাই কি বাংলাদেশ? তারাই কি টাকার জোরে দেশ আর টাকা পাচার করে বিশ্বজয় করবেন?

প্রধানমন্ত্রী কয়েকদিন আগে বলেছেন, সাংবাদিকরা যেন তাদের কোন মালিকের কত টাকা খেলাপি তার হিসাব নিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়ে রিপোর্ট করেন।  সাংবাদিকদের জ্বালা হলো এমন, আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাতে হলে নিজেদের বেতন, বোনাস, চাকরির নিরাপত্তা ঠিক না করে গার্মেন্ট শ্রমিকের বেতন বোনাস নিয়ে কথা বলার উপায় নেই, নিজেরা অনিরাপদ ভবনে টেলিভিশন অফিস খুলে অবৈধ স্থাপনা নিয়ে কথা বলার জো নাই, নিজেদের কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান মর্যাদা ও সুযোগ নিশ্চিত না করে কেন আদালতের নির্দেশনা মেনে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে এখনও যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি হলো না তা নিয়ে উচ্চকিত হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা হই।  চাকরির বাইরে কোনও উপরি আয় বা সুবিধার চেষ্টা না করে ছাপোষা সাধারণ সাংবাদিকেরা কথা বলি আর বলেন বলেই টিকে থাকে এ সমাজ!



 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top