
সেবা ডেস্ক: হাটা চলা, উঠা বসাতে বেশ কষ্ট হয় তাঁর। কিন্তু ভালোবাসা, মমতা কাছে শারীরিক কষ্ট হার মানায় প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠলো তাঁর মাতৃ হৃদয়। ৮৯ বছর বয়সেও হেঁটে হেঁটে বঙ্গবন্ধু কন্যাদের ঘুরিয়ে দেখালেন তাঁর শশুর ভিটে বাড়ি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা দুজনও কিন্তু ছাড়েনি তাঁকে এক মূহুর্ত্তের জন্য।
কখনও হাটার সময়, কখনও বা বসার সময়, তাঁকে ধরে চলতে সাহায্য করছিলেন তারা। যার কথা বলছি তিনি কৃষ্ণা বসু। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র শিশির কুমার বসুর স্ত্রী। শেখ হাসিনা-কৃষ্ণা বসু, তাদের অত্যন্ত বিনয়ী এবং শুদ্ধতম বাঙালি হয়ে ওঠার পেছনে যেমন পিতা-মাতার প্রভাব আছে তেমনি আছে পারিবারিক মূল্যবোধ। বসু পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছিলো আত্মিক যোগাযোগ। দুই পরিবারের সম্পর্কটা বেশ পুরানো। সেই ১৯৪০ সাল থেকে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গে দুই দিনের সফরে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাথে সফরসঙ্গী শেখ রেহানা ও অন্যান্যরা। ২০১৮ সালে ২৬ মে সফরের দ্বিতীয় দিনে আসানসোলে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি উপাধিতে ভূষিত করে।কলকাতায় ফিরে তিনি পরিদর্শনে যান ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান সংগ্রামী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর পৈত্রিক বাড়িতে। তাঁকে স্বাগত জানান নেতাজির দৌহিত্র সাংসদ সুগত বসু এবং তাঁর মা কৃষ্ণা বসুসহ পরিবারের সদস্যরা। লোকসভার সাবেক সদস্য অধ্যাপক কৃষ্ণা বসু বঙ্গবন্ধু কন্যাদের ঘুরিয়ে দেখান নেতাজী ভবন। অবহিত করেন জাদুঘরের নানা দিক সম্পর্কে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যের উপর বি.এ ও এম.এ ডিগ্রী লাভ করা কৃষ্ণা বসুর জন্ম কিন্তু এপার বাংলায়। ঢাকাতে ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৩০ সালে। তাঁর পিতা শ্রী চারু সি. চৌধুরী ছিলেন পশ্চিম বঙ্গীয় আইন পরিষদের সচিব। ১৯৫৫ সালের ৯ ডিসেম্বর সুভাষ চন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎ চন্দ্র বসুর পুত্র ড. শিশির কুমার বসুর সাথে তাঁর বিয়ে হয়।
কৃষ্ণা বসু ও তাঁর প্রয়াত স্বামী শিশির কুমার বসুর সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ মুক্তি পেলেন বঙ্গবন্ধু। ঠিক ৯ দিন বাদে ১৭ জানুয়ারি কলকাতা থেকে এক দল চিকিৎসক নিয়ে ঢাকায় আসেন নেতাজীর ভ্রাতুষ্পুত্র ডক্টর শিশির কুমার বসু। তাকে দেখে জড়িয়ে ধরেন বঙ্গবন্ধু। কাঁদতে কাঁদতে বলেন 'আমার সব শেষ হইয়্যা গেছে'। শিশির বসু বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘যারা দেশের জন্য রক্ত দেয় তাদের কোনো কিছুই হারিয়ে যায় না।’
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয় ১৯৪০ সালে। কলকাতার পুরনো ফোর্ট উইলিয়ামে, ‘ব্ল্যাক হোল’ নামে একটি মিনার ছিল। ব্রিটিশরা দাবি করতো, সিরাজ-উদ-দৌলা ব্ল্যাক হোলে কয়েকজন ব্রিটিশ সেনাকে ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল। আদতে বিষয়টা সত্য ছিল না। নেতাজী মিনারটি সরাতে আন্দোলন শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয় ‘ব্ল্যাক হোল’ সরিয়ে ফেলতে। তখন বঙ্গবন্ধু কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। নেতাজীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে এই ‘ব্ল্যাক হোল’ আন্দোলনে সামিল হলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে পরিচয় হলো ২০ বছরের তরুণ শেখ মুজিবের।
দীর্ঘ প্রায় তিরিশ বছর পর ১৯৭১সালে বঙ্গবন্ধুর সেই নেতাজীর বাড়িটি ঘিরেই চলেছিল মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু কার্যক্রম। এখান থেকেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার। তবে সবচে’ উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল যশোর সীমান্তে একটি দোতলা বাড়িতে স্থাপিত ‘নেতাজী ফিল্ড হাসপাতাল’। ড. শিশির কুমার বসু, বিখ্যাত শল্য চিকিৎসক ড. সত্যেন বসু রায় সহ একদল চিকিৎসক নিয়মিত এই হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। শুধু পুরুষ চিকিৎসকরা নয়, মহিলাদের সংগঠিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার বিষয়টি দেখতেন বিপ্লবী বীণা ভৌমিক। তার নেতৃত্বে সাবেক সাংসদ এই কৃষ্ণা বসু সহ পারদর্শী মহিলারা কলকাতা থেকে ওষুধের বড় বড় বাক্স যশোরে ‘নেতাজী ফিল্ড হাসপাতাল’-এ নিয়ে আসতেন। আহতদের সেবা শুশ্রূষা করতেন। ড. সত্যেন বসু রায় পাক হানাদার বাহিনীর বুলেটে আহত রোগীদের অস্ত্রোপচার করতেন। তারা সুস্থ হয়ে আবার যুদ্ধে ফিরে যেতো। শুধু হাসপাতাল নয়, নিয়মিতভাবে মুক্তিযোদ্ধারা নেতাজীভবনে আসতো এবং বৈঠক করতো। ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ সরকার-কর্তৃক গৃহবন্দী থাকার সময় কলকাতার ভবানীপুরে যে বাড়ি থেকে সুভাষ চন্দ্র বসুর অন্তর্ধান ঘটে, সেই বাড়ি এইভাবেই নেতাজীর অনুপস্থিতিতেই অচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু ও বিভিন্ন সময়ে ভারতের একাধিক রাষ্ট্রপতি এই ভবনে আসেন। বঙ্গবন্ধুর তাঁর নেতাজীর বাড়িতে আর যেতে পারেন নাই, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই ভবন প্রাঙ্গণে পা রাখলেন তারই তনয়া শেখ হাসিনা।
-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।