সেবা ডেস্ক: আজ ওনার শেষ ম্যাচ (বিশ্বকাপ)! একটা সময় 'ফাস্ট বোলিং' শব্দটাই এদেশে অচেনা ছিল। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের হয়ে 'ফাস্ট বোলার' হয়ে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে এসেছিলেন তিনি। ওনার হাত ধরেই এদেশের ফাস্ট বোলিং যাত্রা শুরু হয় এবং ওনাকে দেখেই দেশের তরুণরা বিশ্বাস পেয়েছিলেন যে এইদেশেও ফাস্ট বোলিং করা যায়! দেশের শতশত তরুণ ফাস্ট বোলারের একমাত্র রোল মডেল এই মাশরাফি। শত ঝড়-ঝাপটার পরেও এখনো তিনি দিব্যি খেলে যাচ্ছেন ওনাকে দেখেই বড় হয়ে ওঠা তরুণদের সঙ্গে। তাই স্টিভ রোডস ওনাকে 'যোদ্ধা' বলেন।
অনেকের কাছে তিনি বড় ভাই, অনেকের কাছে তিনি ভালবাসার পাত্র, অনেকের কাছে তিনি অনুপ্রেরণার ভাণ্ডার, অনেকের কাছে তিনি আবেগের ভাণ্ডার আবার অনেকের কাছে তিনি বোঝা, ল্যাংড়া অপদার্থ, পঁচা রাজনীতিবিদ। আবার অন্যভাবে বলতে গেলে তিনি কিছু মানুষের কাছে শুধুমাত্র একজন ক্রিকেটার আর কিছু মানুষের কাছে তিনি অসম্ভব ভাল মানুষ।
এতগুলো মানুষের মধ্যে কার চিন্তাধারাকে আপনি ভুল বলবেন আর কাদেরই বা সঠিক বলবেন! এসব চিন্তাধারকে নিয়ে আপনি একটু বিশ্লেষণ করলে বা গভীরে ঢুকলে দেখবেন, তারা সবাই'ই যার যার মতো করে দেখছে আর সবাই'ই আলাদা আলাদা দিক বিবেচনা করছে। এইদিক থেকে আপনি যদি সবার নিজ নিজ চিন্তাধারা, যুক্তি, বিবেচনাকে সম্মান করতে চান তাহলে আপনি সবাইকে সঠিক বলতে বাধ্য!
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি.. ইদানিং মাশরাফিকে নিয়ে খুব বেশি সমালোচনা হচ্ছে সেটা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই বলেন বা মিডিয়ায়ই বলেন। এতকিছুর প্রাপ্য অবশ্যই তিনি না। ওনার অবদান আমরা ভুলে গেলেও অবশ্যই বাংলার ক্রিকেট কোনদিন ভুলবেনা। আমাদের দেশে ক্রিকেটাররা অফ ফর্মে থাকলে তাদের ধুয়ে দেয়া নতুন কিছু না। তামিমকে দিয়ে সুন্দর একটা প্রসঙ্গ তুলে ধরতে পারি.. সর্বশেষ এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওনি একহাতে ইঞ্জুরি নিয়ে অন্য একহাত নিয়েই নেমে গেছিলেন দেশের জন্য খেলতে! ঐদিন কিন্তু তামিমের বাহবা, প্রশংসার অভাব হয়নি। আর আজ সমালোচনার অভাব হচ্ছেনা সেই একহাত নিয়ে খেলতে নামা তামিমেরই! এমনটা কিন্তু মাশরাফির ক্ষেত্রেও ঘটছে। মাশরাফিও দেশের জন্য তার পা দুটো বিসর্জন দিয়েছেন। ঐদিন কিন্তু মাশরাফির প্রশংসা, মাশরাফির প্রতি কৃতজ্ঞতার অভাব ছিলোনা আর আজ সমালোচনা, গালির অভাব হচ্ছেনা। আহ, বড়ই অদ্ভুত এই দেশ! এই দেশে সবই সম্ভব! অবশ্য এতো সমালোচনা, গালির পেছনে মানুষজন অহরহ যুক্তি দেখাচ্ছেন। যতই হোক, এতটা অপ্রাসঙ্গিক সমালোচনা, গালির প্রাপ্য ওনারা না সেটা চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি।
আর অপরদিক থেকে সাকিবের বিষয়টা দেখুন.. একজন ক্রিকেটার যত ভালই হোন না কেন তার বাজে সময় আসবেই। ঠিক তেমনি সাকিবেরও ছিলো.. ঐসময় কিন্তু সাকিবের মতো বিশ্বসেরাদেরও গালি, সমালোচনার অভাব হয়নি। এইতো কয়দিন আগের কথা.. সাকিব হাতের আঙ্গুলে চোট পেয়েছিলেন খুব তাই ওনার পক্ষে ম্যাচ খেলা কোনভাবেই সম্ভব ছিলোনা। অথচ আমারা না বুঝে না মেনে কতই না গালি দিয়েছি এই সাকিবকে! সাকিব টাকার জন্য খেলে, সে দেশের ভালো চায়না, সে আইপিএল খেলার জন্য দেশের খেলাকে পাত্তা দিচ্ছেনা কতো কি! আর আজ ওনি খুব ভাল ফর্মে আছেন.. তাই ওনার বাহবা, প্রশংসার কমতি নাই! শুধু যে ওনাদের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটেছে তা না দেশের প্রায় ক্রিকেটারদেরই এমন সময় পার করতে হয়েছে।
আমরা এমন কেন? কবে বের হবো এমন মনমানষিকতা থেকে? বলতে পারেন? আমরা ওনাদের ভাল সময়ে পাশে থাকতে পারি, মাথায় তুলতে পারি কিন্তু খারাপ সময়ে কেন তা পারিনা? মানুষের জীবন তো ভাল, খারাপ এই দুই মিলিয়েই.. সেটাকে আমরা কেন মানতে পারছিনা?
মাশরাফি রাজনীতিতে একটা নির্দিষ্ট দলের হয়ে আসায় ওনাকে কম গালি খেতে হয়নি। ওনি সহ ওনার পরিবারের সবাইকেই প্রায় মানুষ এই প্রসঙ্গে খুব গালাগালি করেছে। আর সাকিবের ক্ষেত্রে টানা হয়েছে সাকিবের বউয়ের পর্দা না করা প্রসঙ্গ নিয়ে। ক্রিকেটে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টানা কি এতোটাই জরুরি? আর এটা কতটা যুক্তিসংগত তা বোধগম্য নয়।
আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা অতীত ভুলে যাই। আমরা কিছু মনে রাখতে পারিনা। আমদের মাথার ঘিলু সবসময় এক থাকেনা। আমাদেরকে মানুষ যতদিন দিয়ে যাবে ঠিক ততদিনই আমরা মনে রাখবো.. তারপর ছুড়ে ফেলে দিবো। আমরা অকৃতজ্ঞ, বড়ই অকৃতজ্ঞ!
কিছু মানুষ আছে যারা মাশরাফির আবেগ, মনোবল নিয়ে হাসাহাসি করে তামাশা করে। তাদের বলবো কোন দুঃখে আপনি আবেগের বিরোধী? যে দেশের সূচনালগ্ন থেকেই আবেগ জরিয়ে আছে, যে দেশের প্রতিটা সেক্টরে আবেগের কদর বেশি (সেটা হোক রাজনীতি বা অন্য যেকোন কিছু), যে দেশের প্রতিটা মানুষ প্রচণ্ড আবেগী সে দেশে আপনি আবেগের বিরোধীতা করে কতটা সফল হবেন? আবেগই আমাদের দেশের সব!
ক্রিকেটের ক্ষেত্রেই ধরেন.. সারাবিশ্বে ক্রিকেট শুধুমাত্র একটি খেলা, বিনোদন। আর আমাদের দেশে? আমাদের দেশে একটা আবেগ! ক্রিকেট এদেশে দেশপ্রেম, ভালবাসা, শান্তির প্রতিক! যে দেশের প্রধানমন্ত্রী মাঠে এসে খেলা দেখে, খেলার জন্য মিটিং বাদ দিয়ে দেয়, গভীর রাত জেগে খেলা দেখে, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে দোয়া করে সেই দেশকে নিয়ে আর কি বলবেন। মাঝেমধ্যে ক্রিকেটই আমাদের সব.. ক্রিকেটেই আমাদের খাওয়া দাওয়া, পড়া, ঘুম! এমন দেশ আর কোথাও দেখিনি। এতকিছুর পরেও আপনি আবেগের বিরোধিতা করে যাবেন? আবেগ নিয়ে হাসাহাসি করবেন? বলবেন আবেগ নাই আপনার মধ্যে?.. আপনার অজান্তেই আপনার ভেতর আবেগ লুকিয়ে আছে ; আপনি বাঙ্গালী।
কিছু মানুষ আছে যারা মাশরাফির আবেগকে সম্মান করে, অতীত ভুলে যায়না কখনও, প্রতিটা প্লেয়ারের খারাপ সময়েও পাশে থাকে, ম্যাচ হারার পর প্লেয়ারদের কষ্ট নিজের মধ্যে জাগ্রত করে চোখের জল ফেলে, ফ্যান ভিত্তিক ক্রিকেট বিরোধী.. তাদের বলা যায় কৃতজ্ঞ সমর্থক।
আর কিছু মানুষ আছে.. যারা আবেগ বিরোধী, অতীত ভুলে যায়, পারর্ফমেন্স বিবেচনায় প্লেয়ারদের গালি দেয় অপ্রাসঙ্গিক সমালোচনা করে.. তাদের বলা যায় অকৃতজ্ঞ সমর্থক।
আজ বাংলার ক্রিকেট নাম আবেগে, ভালবাসায় কৃতজ্ঞ সমর্থকদের বড়ই অভাব! বিশ্বক্রিকেটে আজকে যারা রাজত্ব করছে তারা সবাই বড়ই কৃতজ্ঞ। উদাহরণ হিসেবে ইংল্যান্ডের কথাই বলা যাক.. টেস্ট ক্রিকেটের বিখ্যাত ফাস্ট বোলার স্টুয়ার্ট ব্রড একটা সময় ভারতীয় ক্রিকেটার যুবরাজ সিংয়ের হাতে ৬ বলে ৬ টা ছক্কা খেয়েছিলেন.. যেটা লজ্জার রেকর্ডই বলা যায়। কিন্তু এতকিছুর পরেও সে আজ খুবই ভাল অবস্থানে আছে। কারণ ঐদিনও সে তার দেশের প্রতিটা মানুষকে পাশে পেয়েছে, আত্ববিশ্বাস পেয়েছে। তেমনিভাবে বেন স্টোকসের কথাও তো সবারই জানা.. সে ও ৪ বলে ৪ টা ছক্কা খেয়ে টি-২০ বিশ্বকাপটাই হাতছাড়া করে ফেলছিলো! কই তাকে তো কেউ গালি দেয়নি, সমালোচনা করেনি.. অনেক সাহস দিয়েছে। তারা সমর্থক হিসেবে কৃতজ্ঞ। তাই তারা আজ এতো উন্নত ক্রিকেটে।
আমরা মাশরাফিকে ভালবাসি। ওনার আবেগ, সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। চাই যুগ যুগ ধরে খেলে যান। তিনি দেশকে অনেককিছু দিয়েছেন, আরও দিতে চান হয়তো। তিনি দেশকে তার নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন সেটা সবসময়ই প্রমাণিত। প্রতিটা প্লেয়ারের খারাপ সময় আসে.. আজ ওনার খারাপ সময় যাচ্ছে। উনার পাশে থেকে আমাদের উচিত কৃতজ্ঞের পরিচয় দেয়া।
বিশ্বকাপে নিজের শেষটা যেভাবে শেষ করতে চেয়েছিলেন সেভাবে করতে পারেননি। হয়তো এই আক্ষেপটা ওনার মধ্যে আজীবন থেকে যাবে! আমরা আর দেখতে পারবোনা ওনাকে বিশ্বকাপে দেশের হয়ে খেলতে!
খুব করে চাইবো যেন ওনি নিজের ক্যারিয়ারের ইতিটা এখনি আর বিদেশের মাটিতে না টানেন। চাইবো দেশেই যেনো ইতি টানেন।
যেদিনই তিনি ইতি টানবেন.. মিরপুরের মাটিতে গার্ড অব অনার, হাজারও দর্শকের করতালি, চিৎকার ছাড়া যদি এই অসামান্য মানুষটা বাইশ গজ ছেড়ে দেন এর চেয়ে আর খারাপ উদাহরণ কি হতে পারে আমাদের অকৃতজ্ঞতার?
মাশরাফি দেশের মাটিতে একটা গ্রেন্ড ফেয়ারওয়েল ডিজার্ভ করেন। ওনাকে যদি দেশের বাইরে প্রেস কনফারেন্স করে খেলা ছাড়তে হয় তাহলে এই দেশের ক্রিকেট কখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা! মাশরাফি দেশের সেরা দলনেতা আর এখনো দেশের সেরা বোলার (পরিসংখ্যান এর দিক দিয়ে)।
মানুষ আপনাকে ভুলে গেলেও বাংলার ক্রিকেট আপনাকে কোনদিন ভুলবেনা! আপনি আমাদের জীবন্ত কিংবদন্তী! আপনি আমাদের অহংকার! অনেককিছু শিখেছি আমরা আপনার কাছ থেকে।
মাশরাফিরা বারবার আসেনা। মাশরাফি একজনই।
ভালবাসি ক্যাপ্টেন আপনাকে!!
শেষ সময়ে আপনি আমাদের আসল রুপটা দেখতে পেরেছেন! সত্যিই আপনি অনেক ভাগ্যবান!
-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।