
সেবা ডেস্ক: সুলতানা আক্তার লাকি (ছদ্মনাম) বিয়ে হয় ছয় বছর আগে। বিয়ের কিছুদিন পরই তিনি বুঝতে পারেন স্বামীর সঙ্গে একাধিক নারীর অনৈতিক সম্পর্ক আছে। স্বামীকে ফেরাতে অনেক চেষ্টা করেন সুলতানা আক্তার লাকি। এতে স্বামী ক্ষিপ্ত হয়ে তার ওপর অত্যাচার শুরু করে। পারিবারিক টানাপোড়েনের মধ্যেই একে একে দুটি ফুটফুটে মেয়ে জন্ম নেয় সুলতানা আক্তার লাকির সংসারে। এতেও সংসারে মন ফেরেনি স্বামীর। দৈনন্দিন জীবনের হতাশা, স্বামীর অবহেলা, অত্যাচার ধীরে ধীরে সুলতানা আক্তার লাকি কে আরও হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। একসময় এক অপরাধের দায়ে সুলতানা আক্তার লাকির স্বামী জেলে যায়। ওই সময় তাকে সান্ত্বনা দিতে আসা স্বামীর স্বজনরাই সুলতানা আক্তার লাকি কে বিষাদ দূর করতে নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণের পরামর্শ দেন। প্রথমে সিগারেট, তারপর ইয়াবা সেবন শুরু করেন ২৯ বছর বয়সী সুলতানা আক্তার লাকি।
সম্প্রতি ঢাকার আহসানিয়া মিশন হাসপাতালের নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন সুলতানা আক্তার লাকির সঙ্গে কথা হয়। সুলতানা আক্তার লাকি জানান, ইয়াবা সেবনের পর মনে হতো আগের মতো আর মানসিক কষ্ট স্পর্শ করছে না তাকে। ধীরে ধীরে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। স্বামী ও বাবার বাড়ির লোকজন বিষয়টি জানার পর তারা তাকে নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
বেসরকারি সংস্থা আহসানিয়া মিশনের উদ্যোগে ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘অ্যাডিকশন ম্যানেজমেন্ট এন্ড ইনট্রিগ্রেটেড কেয়ার’ শীর্ষক গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, শুধু ফাতেমা নয়, তার মতো অনেক নারীই এভাবে অন্যদের পাল্লায় পড়ে কিংবা হতাশাগ্রস্ত হয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর অনেক নামি স্কুল-কলেজের মেয়েরা মাদকে আসক্ত হচ্ছে। বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যম এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে।
আহসানিয়া মিশন হাসপাতালের প্রোগ্রাম অফিসার (স্বাস্থ্য শাখা) উম্মে জান্নাত জানান, উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত– সব ধরনের পরিবারের নারীরাই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। এদের মধ্যে শিক্ষার্থী যেমন রয়েছেন তেমনি আছেন বিবাহিত নারীও। তবে কী পরিমাণ ছিন্নমূল বা নিম্নবিত্ত পরিবারের নারী মাদকাসক্ত সে বিষয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।
মূলত বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিতদের পাল্লায় পড়ে শিক্ষার্থীরা এ ধরনের কাজে উৎসাহিত হচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, স্কুলের বাথরুমে কিংবা কমনরুমে তারা মাদকের বিনিময় করেন। প্রথমবার সরবরাহকারী অন্যদের বিনামূল্যে মাদক গ্রহণের সুযোগ দেয়। অন্যদিকে বিবাহিত নারীরা পারিবারিক জীবনের হতাশা থেকে মাদকের দিকে ঝুঁকছেন।
জান্নাত আরও বলেন, এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে নারীরা সাধারণত তিন মাস চিকিৎসা নিতে পারেন। মাদকাসক্তদের বয়সসীমা হয় ১৬ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। চিকিৎসা শেষে তাদের নিয়মিত ফলোআপ করা হয়।
তিনি জানান, অনেকে একবার চিকিৎসা নেওয়ার পর আবারও এখানে আসতে পারেন। এ ব্যাপারে বাঁধাধরা নিয়ম নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পুরুষ-নারী সবাই নানা কারণে মাদকাসক্ত হতে পারেন। এর মধ্যে কৌতুহল, বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিতজনের পাল্লায় পড়া, নিজের ইচ্ছায়, প্রেমে ব্যর্থতা, হতাশাবোধ, পারিবারিক হতাশা, মাদকের সহজলভ্যতা ইত্যাদি কারণসমূহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এই পুনর্বাসন কেন্দ্রের আরেকজন নারী ২৩ বছরের জুঁই (ছদ্মনাম)। কথা হয় তার সঙ্গেও। জুঁই জানান, ১৮ বছর বয়সে পরিবারকে লুকিয়ে তিনি পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন তার প্রেমিককে। পরে দুই পরিবারের আশ্বাসে ফিরে আসেন বাড়িতে। কিন্তু পরিবারের কাছে ফিরতেই প্রতিনিয়ত বাবা-মা তাকে দোষারোপ করতে থাকে। অন্যদিকে স্বামীর বাড়িতেও শুরু হয় একই সমস্যা। সবকিছু মিলিয়ে মানসিক অশান্তিতে দিশেহারা হয়ে পড়েন জুঁই। ওই সময় জুঁইয়ের গৃহশিক্ষক তার বিষণ্ণতা কাটাতে এক ধরনের ওষুধ এনে দেন তাকে। দিনে দিনে জুঁইয়ের আসক্তি বাড়ে নেশার ওষুধের প্রতি। প্রথমে বিষণ্ণতার ওষুধ, এরপর সিগারেট, অ্যালকোহল এবং সব শেষে ইয়াবা সেবন শুরু করেন তিনি।
জুঁই জানান, মানসিক অশান্তির কারণে তার আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগতো মনে। মাদক গ্রহণের পর মানসিক কষ্ট কিছুটা কমতো। মাদকের টাকা জোগাড় করতে দুইটি টিউশনি করতেন তিনি।
তিনি জানান, জীবনের হতাশা থেকেই পরিবারকে লুকিয়ে টানা কয়েক বছর নেশা করেছেন তিনি। এখন ভালো হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এদের ৮৪ ভাগ পুরুষ ও ১৬ ভাগ নারী। তবে নারীদের এই হার দ্রুত বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে নারী মাদকাসেবীর সংখ্যা বাড়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন- মাদক গ্রহণ করে ওজন কমানোর প্রবণতা, কৌতুহল, স্বামী, ছেলেবন্ধু কিংবা পরিবারের কাছের মানুষ দ্বারা বাধ্য হওয়া, পারিবারিক কলহ, যৌন নির্যাতনের শিকার, হতাশা, খুব বেশি আবেগপ্রবণতা ইত্যাদি।
ঢাকা আহসানিয়া মিশনের তথ্য অনুযাযী, গত ৫ বছরে দেশে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা বেড়েছে। তাদের পরিচালনায় ২০১৭ সালে মাদকাসক্ত নারীদের ওপর চালানো এক জরিপের ফল থেকে দেখা গেছে, নারী মাদকসেবীদের ৫৬ শতাংশই ইয়াবাসেবী। এছাড়া ঘুমের ওষুধ নেয় ৩৩ শতাংশ নারী, সিগারেট ৩২ শতাংশ, মদ ২৮ শতাংশ, গাঁজা ২৬ শতাংশ, ফেনসিডিল ৯ শতাংশ , হেরোইন ৫ শতাংশ, পেথেড্রিন ৩ শতাংশ এবং ১ শতাংশ নারী ড্যান্ডি নিয়ে থাকে।
গবেষণা বলছে, কোনো পরিবারে পুরুষ মাদকাসক্ত হলে নারীর তুলনায় তাকে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অন্যদিকে সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে দেশে মাদকসেবী নারীরা চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় মাদকাসক্ত হলে তাদের শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকি বেশি থাকে। এ কারণে তার বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে চিকিৎসা পরবর্তী ফলোআপ সেবা ও সঠিক সহযোগিতা না পেলে সে আবার মাদকাসক্ত হতে পারে।
দীর্ঘদিন মাদক গ্রহণের কারণে একজন নারীর শারীরিক ও মানসিক– দুই ধরনের ক্ষতি হয়। এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলেন, মাদক পুরুষ-নারী সবারই ক্ষতি করে। দীর্ঘদিন মাদক নিলে শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লিভার, ফুসফুসের সমস্যা দেখা দেয়। আর যেহেতু নারীদের উর্বরতা বা সন্তান জন্ম দেওয়ার একটা বিষয় থাকে, মাদক গ্রহণে সেটা বাঁধাগ্রস্ত হয়। গর্ভাবস্থায় মাদক গ্রহণ করলে গর্ভস্থ শিশুর নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে।
তিনি জানান, বর্তমানে নারী মাদকসেবীদের মধ্যে ঘুমের ওষুধের পাশাপাশি ইয়াবা সেবনের বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সী, শো-বিজে কর্মরত অনেকেই ইয়াবা সেবন করেন।
ডা. মেখলা জানান, অনেক নারীই মনে করেন ইয়াবা খেলে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়, ওজন কমে যায়। কিন্তু ইয়াবা গ্রহণের ফলে মাংসপেশীর ক্ষয় হয়, চুল পড়ে যায়, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ইয়াবা সেবন করলে কর্মদক্ষতা নষ্ট হয়ে যায়, মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সেই সঙ্গে সার্বিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়।
তার মতে, মাদক প্রতিরোধে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত প্রশ্রয় বা অবহেলা দুটিই সন্তানকে মাদকাসক্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই মাদক নিয়ন্ত্রণে এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে প্রচারণা আরও বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।