জামালপুরের তাঁত শিল্প

S M Ashraful Azom
জামালপুরের তাঁত শিল্প
সেবা ডেস্ক: এক সময় জামালপুরের তাঁত শিল্প খুবই উন্নত ছিল। বর্তমানে এ অঞ্চলে শিল্পটি মৃতপ্রায়। জামালপুর সদর উপজেলার দিকপাইত, মেষ্টা ও তিতপল্লা ইউনিয়নে বর্তমানে কিছু তাঁতী রয়েছে। বকশীগঞ্জ উপজেলায় একটি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট রয়েছে। এ শিল্পটিকে সরকারীভাবে পৃষ্টকতা প্রদান করা হলে শিল্পটি আবারো তার হ্রত গৌরব ফিরে পেতে পারে।

এছাড়াও জামালপুরের নারীদের তৈরি নকশিকাঁথা সম্ভাবনার নতুন দ্বার উম্মোচন করেছে। বর্তমানে নকশীকাঁথা তৈরি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে পরিণত হয়েছে। এখানে তৈরি নকশিকাঁথা এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। নকশিকাঁথা তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন এখানকার নারীরা। জানা যায়, আশির দশকে জামালপুরে ক্ষুদ্র আকারে কারুশিল্পের যাত্রা। বর্তমানে এর চাহিদা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন শিল্পোদ্যোক্তার আবির্ভাব ঘটেছে। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য এ নকশিকাঁথা তৈরি করে নারীরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। জামালপুরের ও হস্তশিল্প নকশিকাঁথা এখন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা ছাড়াও ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় রপ্তানী হচ্ছে।

জামালপুর উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় দরিদ্র, মধ্যবিত্ত এমনকি শিক্ষিত নারীরাও পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন কারুশিল্পের কাজ। এর মাধ্যমে জামালপুর জেলায় সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় প্রায় পাঁচ শতাধিক নারী উদ্যোক্তা। তাদের মাধ্যমে শত শত নারী কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। জামালপুর শহরের আমলাপাড়া, বসাকপাড়া, কলেজ রোড, বকুলতলা, জিগাতলা, মুন্সিপাড়া, মিয়াপাড়া, দড়িপাড়া, বেলটিয়া, পাথালিয়া, পাঁচরাস্তা মোড়সহ শহরের বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে হস্তশিল্পের আকর্ষণীয় শোরুম গড়ে উঠেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা জামালপুরে কারুশিল্পের তৈরি বিভিন্ন ধরনের নকশিকাঁথা, বিছানার চাদর, সোফার কুশন, পাপোশ, ওয়ালম্যাট, ফতুয়া, নকশী করা রকমারি পাঞ্জাবি মহিলাদের হ্যান্ড ব্যাগসহ বিভিন্ন পোশাক কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

কারুশিল্পের জন্য ঋণ সুবিধা অব্যাহত থাকলে মোটা অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে ব্যবসা পরিচালনা করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব ?বে। বর্তমানে জামালপুরে ঘরে বসে ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় জেলার অনেক কর্মমুখী নারী তাদের ব্যবসার প্রসার করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। নারী উদ্যোক্তা ছাইদা বেগম শ্যামা বলেন, ১৫ বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছি। প্রথম দিকে ২০-৩০ মহিলা কর্মী নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও বর্তমানে তার কর্মীসংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। তিনি বলেন, ‘আমার তৈরি কারুশিল্পসামগ্রী এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সুইডেনের বাজারেও স্থান করে নিয়েছে। সুইডেন নাগরিক ক্রিস্টিনা আমার একজন বড় ক্রেতা। তার মাধ্যমেই আমি সেখানকার বাজার ধরতে সক্ষম হয়েছি। এভাবেই জামালপুরের কারুশিল্প দেশ-বিদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

জমে উঠেছে বকশীগঞ্জের জামদানি

জামালপুরের বকশীগঞ্জের পাখিমারা গ্রামের পরিশ্রমী সঞ্জু মিয়া ও তাহমিনার দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি জামদানির চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাদের সফলতায় পাল্টে গেছে বকশীগঞ্জ উপজেলার পাখীমারা গ্রামের নাম।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও এখন পাখীমারা গ্রামের নাম পরিচিত হয়ে উঠেছে। পাল্টে যাচ্ছে পাখীমারা গ্রামবাসীর পেশাও।

জানা গেছে, দুমুঠো ভাতের অভাবে বিধবা মায়ের হাত ধরে কিশোর বয়সে বকশীগঞ্জের পাখীমারা গ্রাম ছেড়ে ঢাকার ডেমরা গিয়েছিলেন প্রয়াত হালিম সরকারের ছেলে সঞ্জু মিয়া। সেখানকার জামদানি পল্লীতে হেলপার হিসেবে সামান্য বেতনে কাজ শুরু করেন তিনি। শুরুতেই জামদানি শিল্পে সফলতার স্বপ্ন দেখেন। এতে অল্প দিনেই তিনি হয়ে ওঠেন একজন দক্ষ জামদানি কারিগর। পরে স্বপ্নপূরণের জন্য ঢাকার ডেমরা থেকে চাকরি ছেড়ে ২০০৪ সালে সঞ্জু মিয়া ছুটে আসেন পৈত্রিক নিবাস পাখিমারা গ্রামে। কারিগর, হেলপার, সুতা ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানা প্রতিকূল পরিবেশে মাত্র একটি তাঁত নিয়ে জামদানি তৈরির কাজ শুরু করেন সঞ্জু মিয়া। এরপর দক্ষ জামদানি কারিগর স্ত্রী তাহমিনা বেগমের সহযোগিতায় তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

এ দম্পতি তাদের হাত আর পায়ের নিপুণতায় মনের মাধুরী মিশিয়ে নতুনত্বের ছোঁয়ায় নজরকাড়া কারুকার্যে বৈচিত্র্যময় ডিজাইনে বাহারি রঙের জামদানি শাড়ি তৈরি করতে শুরু করেন। মান ভালো থাকায় পাইকারি ও খুচরা উভয় শ্রেণির ক্রেতার সুনজরে পড়ে সঞ্জু ও তাহমিনার তাঁতের তৈরি জামদানি শাড়ি। এতে প্রসারিত হয় জামদানি শাড়ির বাণিজ্যিক বাজার। দেশের মানচিত্র পেরিয়ে ভারতসহ বিদেশের বাজারেও কদর বাড়ে সঞ্জু-তাহমিনার জামদানি। দেশ-বিদেশে বেড়ে যায় জামদানির চাহিদা। আর চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে হয় সঞ্জু মিয়াকে।

স্বামী-স্ত্রী মিলে মাত্র একটি তাঁত দিয়ে কাজ শুরু করলেও বর্তমান চিত্র ভিন্ন। সঞ্জু-তাহমিনার জামদানি কারখানায় এখন তাঁতের সংখ্যা ২০টি। বর্তমানে ৫০ জন শ্রমিক তার অধীনে জামদানি তৈরির কাজ করছেন। ৫০ জন শ্রমিককে তিনি প্রতিমাসে বেতন দেন প্রায় তিন লাখ টাকা। প্রতিমাসে কারখানায় তৈরি হয় পর্যাপ্ত জামদানি শাড়ি। প্রতিটি শাড়ির দাম সাত হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। তবে অর্ডার পেলে এর চেয়েও বেশি দামের শাড়ি তৈরি হয় সঞ্জুর জামদানি কারখানায়।

সরেজমিন জানা গেছে, কিছু দিন আগেও পাখিমারা গ্রামের অধিকাংশ দরিদ্র মানুষের প্রধান পেশা ছিল দিনমজুরি আর বাঁশ শিল্পের কাজ। সেই পাখিমারা গ্রাম এখন তাঁতের খটাখট শব্দে কর্মমুখর। সঞ্জু মিয়া ও তার স্ত্রী তাহমিনার কারখানায় কাজ শিখেছেন একই গ্রামের আনারুল ইসলাম, খোকা মিয়া, সবুজ মিয়া, রমজান আলী, মমিন মিয়া ও শিপন মিয়াসহ অনেকে। তারা এখন পাখীমারা গ্রামেই গড়ে তুরেছেন শতাধিক জামদানি তাঁত কারখানা। এতে প্রায় তিন শতাধিক মানুষের বেকারত্ব দূর হয়েছে। পাখীমারা গ্রামের প্রতিটি তাঁতেই এখন তৈরি হচ্ছে উন্নতমানের জামদানি শাড়ি। সবারই ব্যবসা জমজমাট। ঈদকে সামনে রেখে প্রতিটি তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা তাঁত, লাটাই, চক্রা এবং সুতার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

সঞ্জু মিয়া বলেন, “সততা ও স্বপ্নের প্রতি আস্থা থাকার কারণে আমি সফল হয়েছি। আমার পরিবারের কষ্ট দূর হয়েছে। আমার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। পরিবার পরিজন নিয়ে খুব সুখে শান্তিতে আছি। ” তাহমিনা বেগম বলেন, “একসময় পুঁজির জন্য বিভিন্ন ব্যাংক ‌ও এনজিওর এর কাছে ধরণা দিতাম। কিন্তু এখন বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও ঋণ দেওয়ার জন্য আমাদের পেছনে ঘোরে। ” তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হলে শুধু আমাদের নয়, এই গ্রামের প্রতিটি পরিবারের জীবনযাত্রার মান পাল্টে যাবে। ”

বকশীগঞ্জ সদর উপজেলার শামীম তালুকদার জানান, বকশীগঞ্জের জামদানিপল্লী নিয়ে তারা গর্ববোধ করেন। ঐতিহ্যবাহী এ জামদানি শিল্পের প্রসার ঘটাতে জামাদানি শ্রমিকদের সরকারিভাবে উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। বকশীগঞ্জের জামদানি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ব্যাপকভিত্তিতে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। এ জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ জরুরি। এ ছাড়া তিনি বকশীগঞ্জের জামদানি কারখানা মালিকদের সহজ শর্তে পর্যাপ্ত ঋণ সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন ব্যাংক ও বিমা কম্পানিসহ শিল্প উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।


 -সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন


ট্যাগস

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top