
সেবা ডেস্ক: সারাদেশে প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে চিকিৎসকদের পরামর্শ ছিলো মানুষের সমাগম থেকে দূরে থাকা। মুসলমানদের ধর্মীয় অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো জমায়েত হওয়া ছাড়া আদায় করা যায় না। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায় করতে হয়।
নামাজের জামাতে বহু লোকের সমাগম হয়। মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন বলা হয় জুমাকে। সেখানে আরো বড় জমায়েত হয়। সম্প্রতি জুমা ও জামাতের নামাজ নিয়ে আরব বিশ্ব ও উপমহাদেশের আলেমদের বিভিন্ন মতামত ও পরামর্শ সামনে এসেছে। নিম্নে সেগুলোর অনুবাদ তোলে ধরা হচ্ছে।
যথাসম্ভব জুমা না ছাড়া :
জুমার নামাজ ইসলামের অনেক বড় একটি প্রতীক। শরয়ী পরিভাষায় বলা হয় শি’আর। অর্থাৎ যে বিষয়গুলো দ্বারা মুসলিম ও অমুসলিমের মাঝে পার্থক্য ফুটে ওঠে তার অন্যতম হচ্ছে জুমা। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ, মুকিম যে মুসাফির নয় এমন পুরুষের ওপর জুমার নামাজ ফরজ। পবিত্র কোরআনের আয়াত দ্বারা তা স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। জুমার নামাজে শরীক হওয়ার নির্দেশ দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদাররা! জুমার দিন যখন তোমাদেরকে নামাজের জন্য আহ্বান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর জিকিরের দিকে ধাবিত হও এবং বেচা-কেনা ত্যাগ করো (সূরা জুমআ:৯)। তাই জুমার আজানের পর নামাজের প্রতিবন্ধক কোনো কাজ করাকেও ওলামায়ে কেরাম হারাম বলেছেন। আবু দাউদ শরিফে বর্ণিত হয়েছে- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। তবে চার ব্যক্তি ব্যতিত-১. গোলাম, ২. নারী, ৩. নাবালেগ, ৪. অসুস্থ।সুতরাং কোনো শরয়ী কারণ ছাড়া জুমার নামাজ তরক করা মারাত্মক গুনাহ। আল্লাহ তায়ালা তাদের ব্যাপারে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। হাদিসেও এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি এসেছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি- হুজুর (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, যারা জুমার নামাজ ত্যাগ করে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা কঠিন ধমকি দিয়ে বলেন, তাদের অন্তরে মোহর অঙ্কিত করে দেয়া হবে। অতঃপর তারা গাফেলদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে (সহিহ মুসলিম-৮৬৫)।
ইসলাম মানুষের সাধ্যের বাহিরে কোনো বিষয় চাপিয়ে দেন না :
কোনো বিষয় যত গুরুত্বপূর্ণই হোক তা বান্দার সাধ্যের বাইরে হলে তা করতে বাধ্য করা আল্লাহর নীতি নয়। এটা ইসলামের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা কাউকে সাধ্যতীত দায়িত্ব দেন না।’ (সূরা বাকারা-২৮৬)। জুমার নামাজের ক্ষেত্রেও সে দৃষ্টিভঙ্গি মেনে চলা হয়েছে। তাই যখন ভয় এবং ক্ষতি নিশ্চিত হবে তখন জুমার নামাজ পরিত্যাগ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। চাই সে ভয় নিজের ব্যাপারে হোক অথবা পরিবার কিংবা মালের ব্যাপারে। এ প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস (রা.) এর সূত্রে রাসূল (সা.) থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আজান শুনার পর মসজিদে না আসার কোনো সুযোগ নেই। তবে ওজর থাকলে ভিন্ন কথা। তখন সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন সেই ওজর কি? রাসূলে পাক (সা.) বলেন, ভয় এবং অসুস্থতা (আবু দাউদ-৫৫১) সুতরাং শরয়ী কোনো ওজর ছাড়া জুমার নামাজ তরক করার কোনো সুযোগ নাই।বর্তমান সময়ে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে জুমা ছেড়ে দেয়ার প্রসঙ্গটি এখানে আলোচনায় আসতে পারে। রাসূল (সা.) মূলত যারা অসুস্থ তাদেরকে জামাতে না আসার অনুমতি দিয়েছেন। তাই যদি কোনো ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় তাহলে তার কর্তব্য হলো সে মসজিদে নামাজ পড়তে যাবে না। বরং সে নিজ ঘরে নামাজ আদায় করবে। রাসূল (সা.) স্পষ্ট ভাষায় তা উম্মতকে বলে দিয়েছেন। তাঁর (সা.) ভাষায় ‘অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ ব্যক্তির কাছে যাবে না।’ (বুখারী-৫৭৭১, মুসলিম-২২২১)।
যেহেতু মসজিদে অনেক সুস্থ লোক থাকে তাই এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সৌদি আরবের ফতোয়া বোর্ড হাইয়াতু কিবারিল উলামা করোনায় অসুস্থ ব্যক্তির জুমা বা জামাতে উপস্থিত হওয়াকে হারাম বলেছেন।’ কারো কারো মতে এমন ব্যক্তিদের জন্য হাসপাতালগুলোতে যেরকমভাবে আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় তদ্রুপ তাদের জন্যও মসজিদে পৃথক নামাজের জায়গার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ দ্বীনদার চিকিৎসকের পরামর্শকেই গুরুত্ব দিতে হবে।
পূর্বোক্ত হাদিস ছাড়াও এমন অসুস্থ লোকদের জামাতে যাওয়া নিষিদ্ধের আরো বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন- রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পেঁয়াজ খাবে সে যেন মসজিদে না আসে (মুসলিম-৫৬৭)। পেঁয়াজের গন্ধে মানুষের যে পরিমাণ কষ্ট তার চেয়ে এমন রোগীর দ্বারা আরো বহুগুণ বেশি কষ্ট পাবে। তাই আসা নিষিদ্ধ। সুস্থ কোনো ব্যক্তি যদি নিজের ব্যাপারে আশঙ্কা করে সে মসজিদে গেলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে তাহলে তার জন্য মসজিদে নামাজ পড়তে না যাওয়ার সুযোগ আছে। কেননা ইসলাম কারো ক্ষতি করাকে সমর্থন করে না এবং কাউকে বিপদে ফেলে দেয়াকেও সমর্থন করে না।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, তোমরা নিজেদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করো না (বাকারা-১৯৫)। তবে এই ওজরটা ওই ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য, যে এই আশঙ্কার কারণে বাজার, বিনোদন কেন্দ্র ইত্যাদিতে গমন করে না। পক্ষান্তরে যে বাজারে যাওয়া আসা করে এবং কোনো কিছু মনে করে না তার জন্য মসজিদে যাওয়া থেকে বিরত থাকা বৈধ হবে না।
মোটকথা হলো, সৌদি আরবের হাইয়াতু কিবারিল উলামা, আমেরিকার উলামায়ে কেরাম দ্বারা গঠিত শরীয়াহ বোর্ড লাজনাতুত দা’ইমাহসহ বিশ্বের কোনো উলামায়ে কেরামই জুমা কিংবা জামাত বন্ধ করার পক্ষে ফতোয়া দেননি। বরং করোনা ভাইরাস আক্রান্ত শহর, আক্রান্ত ব্যক্তি এবং যাদের নিজেদের ব্যাপারে আশঙ্কা হবে তাদেরকে তাদের স্তর অনুযায়ী হুকুম দিয়েছেন। সুতরাং করোনা ভাইরাস জাতীয় কোনো মহামারীর দোহাই দিয়ে জুমা, জামাত বন্ধ করা যাবে না। ইরাকের সর্বোচ্চ ফতোয়া বোর্ড জুমা নিষিদ্ধের ফতোয়া দিয়ে তার সঙ্গে টিকা যুক্ত করে বলেছেন, ‘জুমার নামাজ একেবারে নিষিদ্ধ না করে তা সীমিত আকারে আদায়ের ব্যবস্থা করা যায়। যেমন প্রত্যেক মসজিদের খতীব, মুআজ্জিন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ জুমার সালাত আদায় করবে। এর বাইরে কেউ শরীক হবে না।’ কাতারের এ ব্যাপারে পদক্ষেপ ছিলো খুবই চমৎকার। তারা জুমার নামাজের অনুমতি দিয়ে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাদের পরামর্শ ছিলো সবাই বাড়ি থেকে ওজু করে আসা। সঙ্গে জায়নামায নিয়ে আসবে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ মসজিদের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ওপরও খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। এর সঙ্গে যেসব মুসল্লির মাঝে করোনার উপসর্গ পাওয়া গেছে তাদের মসজিদে আসা নিষেধ করে দেয়া হয়।
