
জামালপুর সংবাদদাতা : জামালপুর সরিষাবাড়ী পৌরসভার উদ্যোগে নির্মিতব্য মুক্তমঞ্চের পাশের ভাস্কর্য ভাঙচুর ঘটনায় একজনকে আটক করেছে পুলিশ। অভিযোগ ওঠেছে মেয়র রুকুনুজ্জামান রোকনের বিরুদ্ধে কাউন্সিলরদের অনাস্থা ও দল থেকে বহিষ্কার ও অবাঞ্চিত হবার রাগে, ক্ষোভে, প্রতিহিংসায় বৃহষ্পতিবার রাতের অন্ধকারে এ কাণ্ড ঘটানো হয়। পুলিশ পরিস্থিতি অবজার্ভেশন করছেন। ইতোমধ্যেই এ ঘটনায় পাহারাদার ফরিদুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ।
শুক্রবার বিকেলে সরিষাবাড়ী অনার্স কলেজ মাঠে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মুক্তমঞ্চের সামনের ডানপাশে মূল্যবান একটি খেলোয়াড়ের ভাস্কর্য ও মুক্তমঞ্চের সামনের বামপাশের কর্ণারে একটি তবলা হাতে ব্যাঙের ভাস্কর্য পুরোপুরি ভেঙে পড়ে আছে। এছাড়া আরো দু’টি ব্যাঙ ও খেলোয়াড়ের ভাস্কর্য ক্ষতিগ্রস্থ করা হয়েছে। তবে রোকনের নামে নামকরণ করা ‘মেয়র রোকন মুক্ত মঞ্চ’ লেখা ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের নামফলকের কোনো ক্ষতি করা হয়নি।
এ ঘটনার সাথে জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় লোকজন জানান, বৃহষ্পতিবার মধ্যরাতে মেয়র রোকনের নেতৃত্বে পৌরসভার সাতপোয়া উত্তরপাড়া গ্রামের বাংগুর ছেলে আরিফুল ইসলাম, একই গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে আর এম রাকিব, বলারদিয়ার উত্তরপাড়া গ্রামের মকবুল হোসেনের ছেলে সাইদুল ইসলাম, সাতপোয়া গ্রামের মৃত সবুর মণ্ডলের ছেলে এনাম লাভেন্ডার, স্বপনের ছেলে আরিফুল ইসলাম রবিনসহ উচ্ছৃঙ্খল ও নেশাখোর ১৫-২০ জন লোক সরিষাবাড়ী অনার্স কলেজ মাঠে যায়। তারা মেয়রের নির্দেশে ভারী লোহার যন্ত্র দিয়ে মুক্তমঞ্চের সামনে ও দুইপাশে বানানো ইট-পাথর-সিমেন্টের তৈরি চারটি ভাস্কর্য ভাঙচুর করে।
এ ব্যাপারে সরিষাবাড়ী পৌরসভার প্যানেল মেয়র মোহাম্মদ আলী জানান, ‘মেয়রকে অনাস্থা দেয়ার পর থেকেই তিনি কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি হুমকি দিয়েছিলেন যে, আমাদের যেকোনো উপায়ে ফাঁসিয়ে দেবেন। তার অংশ হিসেবেই মেয়র ভাস্কর্যগুলো ভেঙে আমাদের উপর দায় চাপানোর অপচেষ্টা চালিয়েছেন।’এ ব্যাপারে মেয়রের বিরুদ্ধে থানায় আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলেও তিনি জানান।

এদিকে নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্যেই রাতের অন্ধকারে প্রতিহিংসায় সরকারি টাকায় নির্মিতব্য ভাস্কর্য ভাঙচুর করে রাজনৈতিকভাবে অন্যকে হয়রানী ও মেয়রের সহানুভূতি অর্জনের অপচেষ্টাকে ন্যাক্কারজনক বলে মন্তব্য করছেন পৌরবাসী। সরিষাবাড়ী অনার্স কলেজের প্রভাষক মাহমুদুল হাসান দুখু মন্তব্য করেন, ‘মেয়রের এই নোংরা অপরাজনীতিই মনে হয় বাকি ছিল, ধিক্কার জানাই এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতির।’
উপজেলা যুবলীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক শিহাব শেখ মন্তব্য করেন, ‘জইটে বাঘের নাতির কাজ, রাজাকারের বাচ্চা কাভি নেহি আচ্ছা’। জামালপুরের সরিষাবাড়ী অনার্স কলেজের মাঠে এডিপির অর্থায়নে নির্মিতব্য খেলোয়াড়ের ভাস্কর্যগুলো ভেঙে রাজনৈতিকভাবে ফায়সা হাসিল ও নিজের প্রতি পৌরবাসীর সহানুভূতি অর্জনের অপচেষ্টায় ‘রাজাকারের নাতি’ খ্যাত মেয়র রোকন এসব করেন বলে সচেতনমহলের ধারণা।
এদিকে মেয়রের এ ন্যাক্কারজনক ঘটনায় এলাকায় নিন্দার ঝড় বইছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পৌরসভার সচেতন লোকজন ভাঙাচুরা ভাস্কর্যের ছবি পোস্ট করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
পৌরসভা সূত্র জানায়, সরিষাবাড়ী পৌরসভার উদ্যোগে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্থায়নে মেয়র রোকন একক ইচ্ছায় নীতিমালা লঙ্ঘন করে বেশিকিছু সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হাতে নেন। রাস্তা-ঘাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উন্নয়ন কাজ না করে মিনিপার্ক, ডিজিটাল বিশ্রাম ঘর ও যেখানে-সেখানে ভাস্কর্য স্থাপন করেন। সরকারি টাকায় সেগুলো করা হলেও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি সবগুলোই নিজের নামে নামকরণ করেন। এছাড়া পৌরসভার অধিকাংশ কাজ টেণ্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে শুধুমাত্র কোটেশন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এবং নামেমাত্র ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে নিজেই বাস্তবায়ন করে পৌরসভার কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
এদিকে মেয়র রোকনের বিরুদ্ধে এডিপি ও নিজস্ব তহবিলের টাকা, কবরস্থান, বাস টার্মিনাল, ত্রাণ ও মশক নিধন কর্মসূচির বরাদ্দ আত্মসাৎ, টেণ্ডারবাজি, নিয়োগ বানিজ্য, যৌন কেলেঙ্কারি, মদ্যপান, অস্ত্রের মহড়া, নারী কেলেঙ্কারি ঢাকতে গুম নাটক, কাউন্সিলর ও স্টাফদের মাসিক বেতন-ভাতা না দেয়া, সাংবাদিক, কাউন্সিলর ও সাধারণ মানুষকে হত্যার হুমকিসহ শতাধিক অভিযোগে গত ১ মে (শুক্রবার) পৌরসভার সকল কাউন্সিলর একযোগে মেয়রের বিরুদ্ধে অভিযোগে অনাস্থা দেন। একইদিন বিকেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় সভায় রোকনকে ত্রাণ আত্মসাৎ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এতে তিনি পৌরসভায় অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে ১০ মে (রোববার) সকালে মেয়র রোকন পৌর ভবনে জোরপূর্বক ঢুকতে সশস্ত্র হামলা চালান। এতে কয়েক কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতাকর্মীসহ অন্ততঃ ১০ জন আহত হন। এসময় প্রতিবাদী জনতার বাধার মুখে তিনি পৌরসভায় ঢুকতে ব্যর্থ হন। মুক্তমঞ্চের পাশে থেকেই বক্তব্য জানতে মেয়র রুকুনুজ্জামান রোকনকে মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
সরিষাবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু মো. ফজলুল করীম বলেন, ‘পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাঠের পাহারাদার ফরিদুল ইসলামকে আটক করা হয়েছে।’ আটককৃতকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার বক্তব্য শোনে দোষীদের শীঘ্রই আটক করা হবে।