বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম নারী অধ্যক্ষ টাঙ্গাইলের ফজিলতুন্নেসা

S M Ashraful Azom
0
বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম নারী অধ্যক্ষ টাঙ্গাইলের ফজিলতুন্নেসা


সেবা ডেস্ক: ফজিলতুন্নেসা জোহা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ও ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এ হিসেবে তিনি বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম নারী অধ্যক্ষ। তিনিই প্রথম বাংলাদেশের মুসলিম ছাত্রী যিনি উচ্চ শিক্ষার্থে বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে যান।

ফজিলতুন্নেসা সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন বলেন, ফজিলতুন্নেসা অসামান্য সুন্দরীও ছিলেননা অথবা বীনানিন্দিত মঞ্জুভাষিণীও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এম এ এবং একজন উচুঁদরের বাক্‌পটু মেয়ে।

ফজিলতুন্নেসার জন্ম ১৮৯৯ সালে টাঙ্গাইল জেলার টাঙ্গাইল সদর থানার নামদার কুমুল্লী গ্রামে। পিতার নাম ওয়াজেদ আলী খাঁ, মাতা হালিমা খাতুন। 

ওয়াজেদ আলী খাঁ মাইনর স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। স্কুল শিক্ষক হওয়া আগে করোটিয়ার জমিদার বাড়িতে সামান্য একটি চাকরি করতেন। স্কুলে বাৎসরিক পরীক্ষায় মেয়ের ভালো ফলাফল দেখে পারিবারিক অস্বচ্ছলতা আর সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা সত্বেও ফজিলাতুন্নেছাকে শিক্ষার পথে এগিয়ে দেন।

মাত্র ৬ বছর বয়সে ওয়াজেদ আলী খাঁ ফজিলতুন্নেসাকে করটিয়ার প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। তিনি ১৯২১ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক ও ১৯২৩ সালে প্রথম বিভাগে ইডেন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ফজিলাতুন্নেছা ১৯২৫ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে গণিত শাস্ত্রে এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট (গোল্ড মেডালিস্ট) হয়েছিলেন। অতঃপর তিনি ১৯২৮ সালে বিলেতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য গমন করেন। নিখিল বঙ্গে তিনিই প্রথম মুসলিম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। 

উপমহাদেশে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে তিনিই প্রথম বিলেত থেকে ডিগ্রি এনেছিলেন। তার পড়াশোনার ব্যাপারে করটিয়ার জমিদার মরহুম ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া) বিশেষ উৎসাহ ও অর্থ সাহায্য করেন।

বিদেশে পড়ার সময় ফজিলতুন্নেসার সাথে খুলনা নিবাসী আহসান উল্ল্যাহর পুত্র জোহা সাহেবের সাথে ফজিলাতুন্নেছার পরিচয় হয়। পরে উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

লন্ডন থেকে ফিরে ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতায় প্রথমে স্কুল ইন্সপেক্টরের চাকুরিতে যোগদান করেন। ১৯৩০ সালের আগস্টে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলিম সমাজ-সেবক-সংঘে’র বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে তাঁর বক্তব্যটি নারী জাগরণের মাইল ফলক হয়ে আছে। 

এই অধিবেশনে তিনি বলেন ‘নারী-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন ও বলেন। নারী সমাজের অর্ধাঙ্গ, সমাজের পূর্ণতালাভ কোনোদিনই নারীকে বাদ দিয়ে সম্ভব হতে পারে না। সেই জন্যেই আজ এ সমাজ এতোটা পঙ্গু হয়ে পড়েছে।

তিনি আরো বলেন, 
The highest form of society is one in which every man and woman is free to develop his or her individuality and to enrich the society what is more characteristic of himself or herself.

কাজেই এ সমাজের অবনতির প্রধান কারণ নারীকে ঘরে বন্দি করে রেখে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য (individuality) বিকাশের পথ রুদ্ধ করে রাখা। নারী-শিক্ষা সম্বন্ধে এতোটা কথা আজ বলছি তার কারণ সমাজের গোড়ায় যে-গলদ রয়েছে সেটাকে দূরীভূত করতে না-পারলে সমাজকে কখনই সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারা যাবে না।’

প্রথম মুসলিম নারী অধ্যক্ষ

তিনি ১৯৩৫ সালে বেথুন কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। বেথুন কলেজে চাকুরিরত অবস্থায় দেশবিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে এসে ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন ১৯৪৮ সালে।

বেগম ফজিলাতুন্নেছা ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এর আগে কোনো মুসলিম নারী অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেনি তাই তাকে বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম নারী অধ্যক্ষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। 

অধ্যক্ষ হিসেবে বেগম ফজিলাতুন্নেছার অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় বিজ্ঞান ও বাণিজ্যিক বিভাগসহ ইডেন কলেজ ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়। 

১৯৫২ সালে ইডেন কলেজের মেয়েরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কলেজের অভ্যন্তর থেকে মিছিল বের করার প্রস্তুতি নিলে উর্দুভাষী এক দারোগা হোস্টেলে ঢুকে মেয়েদের ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে খবর পেয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা কলেজে এসে তার বিনা অনুমতিতে কলেজ প্রাঙ্গণে ঢোকার জন্য দারোগাকে ভর্ৎসনা করে নিজের দৃঢ়তা ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বলে হোস্টেল থেকে বের করে দেন। 

নারী শিক্ষা ও নারীমুক্তি সম্পর্কে সওগাতসহ অনেক পত্রিকায় তার বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশিত হয়।

নজরুল ও ফজিলাতুন্নেছা 

১৯২৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নজরুলের দ্বিতীয় দফা ঢাকা সফরের সময় ফজিলতুন্নেসার সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে। ফজিলতুন্নেসা তখন ঢাকার দেওয়ান বাজারস্থ হাসিনা মঞ্জিলে থাকতেন। 

কাজী মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে ফজিলতুন্নেসা জানতে পারেন নজরুল হাত দেখে ভাগ্য বলতে পারেন এবং ফজিলতুন্নেসারও তার হাত নজরুলকে দেখাবার ইচ্ছা হয়। এভাবে ফজিলতুন্নেসা ও তার বোন সফীকুননেসার সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে ফজিলতুন্নেসার বাসায়। 

কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা থেকে জানা যায়, সেই দিন রাতেই নজরুল ফজিলতুন্নেসার ঘরে যান এবং প্রেম নিবেদন করেন। ফজিলতুন্নেসা নজরুলের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।

নজরুল ফজিলতুন্নেসার বিলেত গমন উপলেক্ষে ‘’বর্ষা-বিদায়” নামক একটি কবিতা লেখেন। কলকাতা ফিরে গিয়ে নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে একটি কাব্যিক চিঠি লেখেন। সেই কাব্যিক চিঠির নাম রহস্যময়ী (পরে তুমি মোরে ভুলিয়াছ নাম দেওয়া হয়)।

কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন, “ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা দু’তিন বছরের সময়-সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়”।

এই বিদুষী নারী ১৯৭৭ সালে ২১ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। এই মহীয়সী নারীর স্মৃতি রক্ষার্থে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৭ সালে ফজিলাতুন্নেছার নামে হল নির্মাণ করা হয়।   



শেয়ার করুন

-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন
ট্যাগস

Post a Comment

0Comments

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top