অন্ধকার জীবন পাড় করছে বকশীগঞ্জের চার দৃষ্টিহীন ভাই

S M Ashraful Azom
0
অন্ধকার জীবন পাড়  করছে বকশীগঞ্জের চার দৃষ্টিহীন ভাই



জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার নিলক্ষিয়া ইউনিয়নের জানকিপুর দড়িপাড়া গ্রামে স্বামী, চার ছেলে ও এক কন্যাসন্তান নিয়ে নাছিমা বেগম বসবাস করেন । নাছিমার চার ছেলেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী।- খবর নিউজবাংলা২৪

জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে অন্ধ হয়ে যাওয়া চার ছেলে নাজমুল, নয়ন, মোফাজ্জল ও আজিম উদ্দিনকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে পরিবারটি। অর্থের অভাবে চিকিৎসার সুযোগ হয়নি।

অভাবের মধ্যে থেকেও উচ্চ মাধ্যমিকে লেখাপড়া করছেন নয়ন ও মোফাজ্জল। প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে আজিম উদ্দিন। বিয়ে দিয়েছেন বড় ছেলে নাজমুলকে। সেই ঘরেও রয়েছে দুটি সন্তান।

নাছিমার স্বামী ফুল মামুদ বলেন, ‘আমার তিন বিঘা জমি আছে। ওইডে আবাদ করি আর অটো চালায়ে ১০ জনের সংসারের খাওন চালাইতাছি। লকডাউনে অটো চালানি বন্ধ। এহন কোনো বেলা খায়ে থাহি, কোনো বেলা না খায়ে থাহি।

‘হাজার কষ্টের মধ্যেও তিনডে পুলারে পড়াইতাছি, কিন্তু আমি মইরে গেলেগা এই পুলাডিরে দেহার আর কেউ নাই। ওরা অথই সাগরের মধ্যে পইড়ে যাবো গা। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, আমার পুলাডিরে যদি কিছু এডা ব্যবস্থা কইরে দেয়, তাইলে আমি মইরেও শান্তি পামু।’

নাছিমা বেগম বলেন, ‘আমার চারটে পুলাই জন্মের দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই অন্ধ হয়ে যায়। আমার তো অতো টেকা নাই। তাউ আমি কিছু কবিরাজ, ডাক্তার দেখাইছি। আমি চিকিৎসা করবের পাই নেই টাকার অভাবে।

‘সরকারতো কতো টেহাই খরচ করে। যদি আমার চারটে পুলারে একটু চিকিৎসা করতো। এর মধ্যে দুইডে পুলাউ যদি চোখে দেখবের পাইতো। আমার কইলজে ডা ঠাণ্ডা হইতো।’

ফুল মামুদ ও নাছিমা দম্পতির বড় ছেলে ২২ বছর বয়সী নাজমুল হক বলেন, ‘চার ভাইয়ের মধ্যে আমিই একমাত্র বিবাহিত। আমি আমার ছেলে-মেয়ের মুখটাউ দেখতে পারতাছি না। আমরা চার ভাইয়ের মধ্যে যদি একটা ভাইও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাইতাম, তাহলে আর তিনটা ভাই চলতে পারতাম।’

এই দম্পতির দ্বিতীয় ছেলে ২০ বছর বয়সী নয়ন বলেন, ‘আমি বকশীগঞ্জের গাজী আমানুজ্জামান মডার্ন কলেজে মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। এসএসসিতে আমি জিপিএ ৩.৯৪ পেয়েছি। আমি আর মোফাজ্জ্বল যখন এসএসসি পরীক্ষা দেই, তখন আমাদের শ্রুতিলেখক ভাড়া করতে মোট ২৯ হাজার টাকা খরচ হয়। সে সময় অনেকেই সাহায্য করার কথা বলে কেউ করেনি। পরে গরু বিক্রি করে আব্বা-মা আমাদের টাকা দিছেন।’

নয়নের ভাই ১৭ বছর বয়সী মোফাজ্জ্বল হক বলেন, ‘আমি এসএসসিতে জিপিএ ৪.৩৯ পেয়েছি। এখন এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে আবারও শ্রুতিলেখক প্রয়োজন। তবে আমাদের পক্ষে আর টাকা জোগাড় করা সম্ভব না। হয়তো অর্থের অভাবে আমরা এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারব না। সরকার যদি একটু সহায়তা করে তাহলে আমরা পরীক্ষা দিতে পারব।’

নাছিমার চতুর্থ ছেলে ১২ বছর বয়সী আজিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি সবেমাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। আমার ইচ্ছা আছে শিক্ষক হব। আসলে শিক্ষকতা ছাড়া আমাদের আর কোনো চাকরি নেই। তাই আমি বড় হয়ে শিক্ষক হয়ে আমার বাবা-মাকে আর কোনো কষ্ট করতে দিব না।’

প্রতিবেশীরা জানান, জন্মের পর থেকে তারা আস্তে আস্তে অন্ধ হয়ে গেছে। এই ঘটনা বিরল। নাছিমার প্রতিটি ছেলেই খুব মেধাবী। তাদের মধ্যে মোফাজ্জল অনেক সুন্দর গান গায়। সরকার যদি আর্থিকভাবে একটু সহযোগিতা করে তাহলে পরিবারটি ভালোভাবে বাঁচতে পারত।

বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রতাপ কুমার নন্দী বলেন, ‘কিছু প্রয়োজনীয় খাবার আছে, যেগুলো না খেলে পুষ্টির অভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যায়। এছাড়া কিছু জন্মগত রোগ আছে, সেগুলোর কারণেও মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। এসব বিষয়ে সচেতনতা এবং প্রচার দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই চার ভাইকে আমরা একজন আই স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করব। জানার চেষ্টা করব, ঠিক কী কারণে তারা জন্মের চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে অন্ধ হয়ে গেল, আর চিকিৎসা করে তাদেরকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় কিনা।’

বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুন মুন জাহান লিজা বলেন, ‘একই পরিবারের চারজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর মধ্যে নাজমুল ও মোফাজ্জল প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। আর নয়ন ও আজিম উদ্দিন পাচ্ছেন শিক্ষা উপবৃত্তি। তাদের দুজনকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ডও দেয়া হবে।’

তারা যেন সরকারের সুযোগ-সুবিধা পায় এবং সমাজে পিছিয়ে না পড়ে সে জন্য উপজেলা প্রশাসন তাদের পাশে থাকবে বলেও জানান ইউএনও মুন মুন জাহান। 


শেয়ার করুন

-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন
ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top