সেবা ডেস্ক: রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ভালোবাসা কতটা গভীর, তা প্রকাশ করার জন্য যুগে যুগে মুসলিমরা বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন।
কিন্তু যখন ১২ই রবিউল আউয়ালকে কেন্দ্র করে তাঁর জন্মদিন পালনের জন্য "ঈদে মিলাদুন্নবী" নামে একটি বিশেষ উৎসবের প্রচলন হয়, তখন মুসলিম সমাজে একটি গভীর বিতর্কের সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন ওঠে, এটি কি সত্যিই রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের একটি বৈধ উপায়, নাকি এটি ধর্মের মধ্যে একটি নতুনত্ব বা বিদআত, যা ইসলাম অনুমোদন করে না? এই লেখাটিতে আমরা এই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।
ভালোবাসার প্রকাশ: ইবাদত না প্রথা?
ভালোবাসা এমন একটি অনুভূতি যা সাধারণত বাহ্যিক কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো তাঁদের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করা। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, “বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)
এই আয়াতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, রাসূল ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা কোনো বিশেষ দিনের অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাঁর আদর্শকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণ করার মাধ্যমেই তা প্রকৃত রূপ লাভ করে।
যারা রাসূলের জন্মদিন পালন করেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করা। কিন্তু এই ভালোবাসা প্রকাশের পদ্ধতি কি ইসলাম দ্বারা অনুমোদিত? ইসলামে ইবাদত এবং উৎসবের নিয়মাবলী আল্লাহ তা’আলা এবং তাঁর রাসূল ﷺ দ্বারা নির্ধারিত। এখানে মানুষের নিজস্ব পছন্দ বা উদ্ভাবনের কোনো সুযোগ নেই।
নতুনত্ব (বিদআত) কেন বর্জনীয়?
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, "আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম।" (সুরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৩)
এই আয়াত প্রমাণ করে যে, রাসূল ﷺ-এর ইন্তেকালের আগেই ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। সুতরাং, এর মধ্যে নতুন করে কোনো কিছু যুক্ত করার প্রয়োজন নেই।
রাসূল ﷺ নিজেই এই ধরনের নতুনত্বের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, "যে ব্যক্তি আমাদের এই দীনের মধ্যে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করবে যা এর অংশ নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।" (বুখারি ও মুসলিম)
অন্য একটি হাদিসে তিনি আরও বলেছেন, "নিশ্চয়ই সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো (দীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। এবং প্রতিটি নব উদ্ভাবিত বিষয় হলো বিদআত, আর প্রতিটি বিদআত হলো গোমরাহী।" (মুসলিম) এই হাদিসগুলি থেকে স্পষ্ট যে, ইসলামে নতুন কোনো আমল বা প্রথা যুক্ত করা কেবলই গোমরাহী এবং তা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের যুক্তি এবং এর পর্যালোচনা
যাদের মতে রাসূলের জন্মদিন পালন করা জায়েয, তাদের প্রধান যুক্তিগুলো হলো:
- ভালোবাসা প্রকাশ: তারা বলেন, এই দিনটি রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের একটি মাধ্যম।
- ভালো বিদআত (বিদআতে হাসানা): তাদের মতে, এটি একটি ভালো কাজ, যা মানুষের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি জাগায়।
- রাসূলের সম্মান: তারা মনে করেন, অন্যান্য ধর্মের মানুষ তাদের নবীর জন্মদিন পালন করলে আমরা কেন আমাদের নবীর জন্মদিন পালন করব না?
এই যুক্তিগুলোর পর্যালোচনা করলে দেখা যায়
- ভালোবাসা প্রকাশের সঠিক পথ: আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে, রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের সঠিক পথ হলো তাঁর সুন্নত অনুসরণ করা, কেবল একটি নির্দিষ্ট দিনে উৎসব পালন করা নয়।
- বিদআতে হাসানা বলে কিছু নেই: রাসূল ﷺ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী। এখানে ভালো-মন্দ কোনো প্রকারভেদ করা হয়নি। নামাজ সবচেয়ে বড় ইবাদত, কিন্তু তা যদি রাসূলের নিষিদ্ধ স্থানে (যেমন কবরস্থান) পড়া হয়, তাহলে তা বাতিল হয়ে যাবে। তেমনিভাবে, যে আমল শরীয়তের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক, তা যতই ভালো মনে হোক না কেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
- বিধর্মীদের অনুকরণ: রাসূল ﷺ তাঁর উম্মতকে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের অনুকরণ করতে নিষেধ করেছেন। জন্মদিন পালন করা একটি বিধর্মীয় সংস্কৃতি, যা ইসলাম অনুমোদন করে না। রাসূল ﷺ বলেছেন, "যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।" (আবু দাউদ)
- ঐতিহাসিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: রাসূলের জন্মদিন পালনের প্রথাটি ইসলামের প্রথম কয়েক শতকে বিদ্যমান ছিল না। এটি নবীর ﷺ ইন্তেকালের প্রায় ৬০০ বছর পর ইরাকের শাসক আল-মুজাফ্ফর আবু সাঈদ আল-কুকবুরী-এর মাধ্যমে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। শিয়া শাসকদের প্রভাবে তিনি এই উৎসব চালু করেন। সেই সময়কার প্রসিদ্ধ অনেক আলেম, যেমন ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ, আল্লামা ইবনে কাসীর এবং ইমাম সুয়ূতীসহ অনেক ফকিহ ও মুহাদ্দিস এই উৎসবের সমালোচনা করেছেন এবং এটিকে বিদআত বলে আখ্যায়িত করেছেন। যদি এটি কোনো সওয়াবের কাজ হতো, তাহলে ইসলামের সোনালি যুগের মুসলিমরা অবশ্যই এটি পালন করতেন।
- জন্মতারিখের অনিশ্চয়তা : রাসূলের ﷺ জন্মতারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে গভীর মতপার্থক্য রয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, তার জন্ম ২, ৮, ৯, ১০ বা ১২ রবিউল আউয়ালে হতে পারে। এই বিষয়ে একক ও নিশ্চিত কোনো মত নেই। অন্যদিকে, প্রায় সব ঐতিহাসিক এবং হাদিসবিদ একমত যে, রাসূলের ﷺ ইন্তেকাল হয়েছে ১২ রবিউল আউয়ালে। তাহলে প্রশ্ন আসে, যে তারিখটি নিয়ে এত বিতর্ক, সেই তারিখেই কেন আনন্দ-উৎসব করা হয়? আর যে তারিখে তাঁর ইন্তেকাল হয়েছে, সেই দিনে কীভাবে খুশি প্রকাশ করা যায়? সাহাবিরা তো সেদিন শোকাহত হয়েছিলেন।
বিদআত নয় সুন্নাহর অনুসরণ করুন
রাসূল ﷺ-এর জন্মদিন পালন করা মূলত ইসলামে একটি নতুন সংযোজন, যা কোরআন, হাদিস এবং সাহাবিদের আমল দ্বারা প্রমাণিত নয়। এটি ভালোবাসার এক ভুল বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃত ভালোবাসা হলো তাঁর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা, তাঁর আদর্শকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা এবং বিদআত থেকে দূরে থাকা। রাসূল ﷺ নিজে এবং তাঁর সাহাবিগণ এটি পালন করেননি, যা এই প্রথাটির অগ্রহণযোগ্যতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
তাই, রাসূল ﷺ-এর জন্মদিন পালনকে যারা ভালোবাসা হিসেবে দেখেন, তাদের উচিত ভালোবাসা প্রকাশের সঠিক পথ সম্পর্কে জানা। ভালোবাসা মানেই কোনো প্রথা বা উৎসব নয়, বরং রাসূল ﷺ-এর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করাই হলো তাঁর প্রতি আমাদের গভীর ভালোবাসার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
লেখক ও সমাজ গবেষক
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।