লেখক আবদুল্লাহ আল-হারুন : সংক্ষিপ্ত জীবন-কথা

Seba Hot News : সেবা হট নিউজ
0

শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: অপ্রতিরোধ্য, বেপরোয়া, দুঃসাহসী, বোহেমিয়ান অথচ কোমল ধৈর্যশীল স্বভাবের ৮০ বছর বয়সী চির তরুণ লেখক আবদুল্লাহ আল-হারুন (জন্ম. ১১ই অক্টোবর ১৯৪৫,পিতার চাকরিসূত্রে রাজশাহীর, আদিনায়, পৈত্রিক নিবাস বকশীগঞ্জের কাকিলাকুড়া)-সেই যে ছোটবেলা থেকে ব্যাপক পড়াশোনা শুরু করেছিলেন, তারপর থেকে আজ অবধি বহু চড়ায় উতরাই, বহু উত্থান পতনের ভেতর যেতে হলেও অধ্যয়ন অব্যাহত রেখেছেন। অসম্ভব সংগ্রামী জীবন।

Writer-Abdullah-Al-Harun-A-Short-Biography
লেখক আবদুল্লাহ আল-হারুন


প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও থামেননি কখনো। রুখে দাঁড়িয়ে আছেন অকুতোভয়ে। যার ফলে আজ অবধি শিরদাঁড়া সোজা রেখেছেন, বোঝা হননি কারো। জীবন জীবিকার তাগিদে কখনো তাকে অধ্যাপনা, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা ও জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা, হোটেলে বাসনকোচন ধোওয়া ও নাইট অডিটরের চাকরি প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে জার্মানির একটি শহরে জীবনযুদ্ধের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করছেন তিনি।


আবদুল্লাহ আল-হারুন এক মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবার চাকরি সূত্রে রাজশাহীর আদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে উঠেছেন জামালপুরের বকশীগঞ্জের কাকিলাকুড়ায়। তার পিতার নাম এ. এইচ. এম. এ. কুদ্দুস ও মাতার নাম ফাতেমা খাতুন। হারুনের পিতা আবুল হোফজাজ মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস তদানীন্তন জামালপুর মহকুমার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ছিলেন। 

তিনি কর্মজীবনে অধুনা সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ (অধ্যক্ষকাল ১৯৪৮-১৯৫৫), বগুড়া সরকারি কলেজ (অধ্যক্ষকাল ১৯৬৭-১৯৭২)সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। থাকতেন কলেজেরই কম্পাউন্ডের বাসভবনে। সেই সুবাদে কলেজ লাইব্রেরিতে হারুনের বই পড়ার আগ্রহ আর সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ শৈশব থেকেই। 


এ প্রসঙ্গে তার সহোদর অগ্রজ আবদুল্লাহ আল-মামুন (১৯৪২-২০০৮ ) লিখেছেন : 

‘‘… লাইব্রেরীর বই পড়ার ক্ষেত্রে অবশ্য ছোট ভাই হারুণ আমার চেয়ে অনেক বেশি পারদর্শিতার রেকর্ড রেখেছে। হারুণ ছোট থেকেই বইয়ের পোকা। যে কোনো পড়ার বস্তু সে অনায়াসে গিলতে পারে। সে সময় দেখেছি, নতুন বছরের নতুন ক্লাসে উঠার পর নতুন বইগুলো আসামাত্র হারুণ সব রকম কাজে ইস্তাফা দিয়ে গোগ্রাসে বইগুলো গিলে ফেলত। এবং সারা বছর আর বইগুলো পড়ার নাম করত না। কেননা ওসব তো সেই কবে পড়া হয়ে গেছে।’’ [আবদুল্লাহ আল-মামুন, আমার আমি, অনন্য, ১৯৯৬, পৃ. ১১-১২] 


হারুন ছিলেন চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। নাট্যজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র নটরাজ আবদুল্লাহ আল মামুন তার সহোদর অগ্রজ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হারুন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে বি.এ. (অনার্স) ও এম.এ. সম্পন্ন করেন। 

ছাত্র জীবনে করেছেন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি। অংশগ্রহণ করেছেন নানা মিছিল মিটিংয়ে। প্রথম জীবনে কিছুদিন তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যাপনা করেছেন, অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন সরিষাবাড়ী কলেজে।


স্বাধীনতাত্তোর সদ্য বাংলাদেশের একটি জেলায় এনডিসি পদে থেকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে তাকে জড়িয়ে একটি ফৌজদারি মামলা হয়। ১৯৭৫ সালে পট-পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে সামরিক আইন (মার্শাল ল) জারি হলে উক্ত মামলা পরবর্তীকালে সামরিক আদালতে (মার্শাল ল' কোর্ট) যায়। 

রাজশাহীতে গঠিত একটি সামরিক আদালতে তার বিনা উপস্থিতিতে উক্ত মামলার বিচার করে তাকে অন্যায়ভাবে কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং তিনি দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। ১৯৭৭ সালে প্রথমে গ্রীস ও পরে ১৯৭৯ সাল থেকে জার্মানিতে স্থায়ীভাবে বসবাস। 

উল্লেখ্য, দীর্ঘ চার দশক পরে সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ উক্ত সরকারের আমলে সামরিক আদালতের কারাদণ্ডকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং দণ্ডিতদেরকে দেশপ্রেমিক হিসেবে গণ্য করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।


লেখক আব্দুল্লাহ আল-হারুন নিয়ে আরও পড়ুন:

আবদুল্লাহ আল-হারুনের  'কালের মন্দিরা'

আবদুল্লাহ আল-হারুনের 'কালের মন্দিরা'

আবদুল্লাহ আল-হারুনের ‘হৃদয় মিশেছে মৃত্তিকায়’ যেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি

আবদুল্লাহ আল-হারুনের ‘হৃদয় মিশেছে মৃত্তিকায়’ যেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি




প্রবাসে পেশাগত জীবনে হারুন বিচিত্র, বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ইংরেজি, জার্মান, হিন্দি, উর্দুসহ কয়েকটি ভাষায় দক্ষ তিনি। 

অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকাসহ ঘুরেছেন সমগ্র ইউরোপ। দেখেছেন বহু বিচিত্র মানুষ, প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছেন বহু রুদ্ধশ্বাস চাঞ্চল্য কর ঘটনা প্রবাহের, সাক্ষী ছিলেন বহু ঐতিহাসিক মুহূর্তের। 

সুইজারল্যান্ডের দাভোজে সাত তারকা হোটেল বেলভেদ্রে নাইট অডিটরের চাকরিরত কালে পৃথিবীর অনেক রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ও ধনাঢ্য ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। এদের মধ্যে বিল ক্লিন্টন, নেলসন ম্যান্ডেলা, কফি আনান, পিটার উস্তিনভ, পল ম্যাকার্টনি, ম্যাডোনা, রোমান পোলানস্কি, বিল গেটস, টনি ব্লেয়ার, প্রিন্স চার্লস প্রমুখ অন্যতম। 

ইউরোপে মারগারেট ও মিরিয়াম জোনাথন এবং মেলির উষ্ণ সান্নিধ্য ও ভালোবাসা তার জীবনের এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি। 


হারুন নিজের কর্মময় জীবন, কখনো বেকার ও ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে ৬৫ বছর বয়সে জীবনের এক পড়ন্ত বেলায় এসে লেখালিখি শুরু করেন। যদিও এই বয়সে অনেকে বিশ্রম নেন। 

সঙ্গতকারণে তার লেখক সত্তা পরিচয় ততোটা প্রচার পাইনি বলে অনুমিত হয়। অনেক দেরিতে কলম ধরলেও তার লেখার গভীরতা, বিস্তর পড়াশোনার ব্যাপকতার কারণে লেখাগুলো হৃদয়কে স্পর্শ করে। 

ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি এবং বিজ্ঞান বিষয়ও তার জ্ঞান অলোকসামান্য। তার মননশীল চিন্তা চেতনা জ্ঞানের প্রখরতা জার্মান প্রফেসর তো বটেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকেও ছাড়িয়ে গেছে। 


১৯৮১ সাল থেকে হসপিস, প্যালিয়েটিভ কেয়ার এবং মৃত্যু নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করছেন তিনি। প্রগতিভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে তার লেখায় সময় ও সমাজ অন্বেষার পরিচয় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। 

বাংলা ভাষায় মৃত্যু ও মৃত্যুসঙ্গ নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও রচনার পথিকৃৎ তিনি। তার লেখা আত্মজৈবনিক রচনা ও স্মৃতিকথাভিত্তিক প্রবন্ধ আধুনিক ইতিহাস রচনায় অনন্য ভূমিকা রাখবে। 


আধুনিক নগর সভ্যতার বিধ্বংসী জীবন সম্পর্কে নানা দৃষ্টিভঙ্গি তার রচনার অনুষঙ্গ। তার লেখায় মানবিক প্রেম আর ভালোবাসার উদ্বোধন লক্ষ্য করা যায়। 

উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, সূক্ষ্ম রসবোধ, বাস্তববাদী মনোভাব তার রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। আমাদের কাছে মনে হয়েছে বাংলা সাহিত্যে এই লেখককে মনে রাখবে মননশীল গবেষিত স্মৃতিকথামূলক প্রবন্ধ রচনার জন্যে। তার গ্রন্থ পাঠ করে এই প্রতিতি হয়েছে যে, তিনি স্মৃতিকথামূলক সাহিত্যের একটি পথের সন্ধান দিয়েছেন- বাংলাদেশের জন্য, বাংলা সাহিত্যের জন্য।


২০০৮ সালে তাঁর প্রথম বই ‘প্রবাসে দৈবের বশে’ প্রকাশিত হলে সাহিত্য-বোদ্ধামহলে বেশ সাড়া পড়ে যায়। গ্রন্থটি ব্যাপক পাঠক-প্রিয়তা পায়। বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট লেখক, গবেষক হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর একে একে প্রকাশিত হতে থাকে অনেক গ্রন্থ। 

হারুনের লেখা পড়ে সহোদর অগ্রজ আবদুল্লাহ আল মামুন (১৯৪২-২০০৮) তার সম্পর্কে বলেছিলেন, “এত দেরি করে শুরু করলে কেন? ভালোই তো লিখেছ বন্ধ করো না চালিয়ে যাও।” 


মৌলিক, অনুবাদ, গবেষণাসহ তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৩০টি। 

তার প্রকাশিত গ্রন্থ : 

মৌলিকগ্রন্থ : প্রবাসে দৈবের বশে (২০০৮), জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে (২০০৯), হৃদয় মিশেছে মৃত্তিকায় (২০১০), অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন (২০১০), মৃত্যু একটি দার্শনিক জিজ্ঞাসা (২০১১), মৃত্যুসঙ্গীর দিনলিপি (২০১৭), রাজদর্শন (২০১৯), বেলভেদ্রের বিনোদিনী (২০১৯), বিটবুর্গ রহস্য (২০২৪), কালের মন্দিরা (২০২৫) প্রভৃতি অন্যতম।


অনুবাদগ্রন্থ : প্যারিস প্রবাসী কবি ইমলাক খানের কবিতা ওয়ার্ল্ড ইজ অ্যা স্টেজ (বাংলা থেকে জার্মান ও ইংরেজি) (২০১০), বিখ্যাত সুইডিস লেখক Per Anderson Fogelstrom -এর ননফিকশন City of my Dreams: (আমার স্বপ্নের শহর) (২০১১), জার্মান নোবেল লরিয়েট লেখক Herta Müller-এর ননফিকশন Atemschaukel (হৃদস্পন্দন আশা হয়ে বাজে) (জার্মান থেকে বাংলা) (২০১১), মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য 'বিগ ব্যাং থিউরি'র প্রবক্তা স্টিফেন হকিং-এর THE GRAND DESIGN (ইংরেজি থেকে বাংলা) (২০১১), My Brief History (ইংরেজি থেকে বাংলা) (২০১৮), A Life for Science (জার্মানি থেকে বাংলা) (২০২৪), যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের THE JOURNEY (ইংরেজি থেকে বাংলা) (২০১১), ভারতীয় দার্শনিক জে কৃষ্ণমূর্তির The Meditations (ধ্যান নিরন্তর) (ইংরেজি থেকে বাংলা) (২০১৮), প্রখ্যাত আমেরিকান লেখক John Perkins-এর Confessions of an Economic Hit Man (ইংরেজি থেকে বাংলা) (২০১২), প্রখ্যাত আমেরিকান নিউরোসার্জন ইবেন আলেক্সান্ডার-এর Proof of Heaven (প্রুফ অব হ্যাভেন) (ইংরেজি থেকে বাংলা) (২০২৪), বিখ্যাত সুইস শিশুসাহিত্যিক Johanna Spyri-এর HEIDI (Heidis Lehr- und Wanderjahre) (হাইদি) শিশুতোষ কাহিনি (জার্মান থেকে বাংলা) (২০২৪), ভারতীয় যোগী ও বিশিষ্ট লেখক সদগুরু (Sadhguru)-এর Death an inside Story (ইংরেজি থেকে বাংলা) (২০২৪) প্রভৃতি অন্যতম। হারুন কালের হাতে যে সঞ্চয় রেখেছেন তা অমূল্য, অনন্য।


অসম্ভব বন্ধু বৎসল, সদালাপি, সদা হাসিখুশি, তুমুল আড্ডা প্রিয় আবদুল্লাহ আল-হারুন যে কোনো ধরনের আড্ডার মধ্যমণি হয়ে উঠতে বেশি একটা সময় নেন না। তিনি একাই একশ। জাতিকুল বয়সের বালাই নেই। মধুর কণ্ঠ, মজলিশি মেজাজ আর বৈদগ্ধ্য ও অসামান্য স্মৃতিশক্তির বিরল সংমিশ্রণে তার আলাপচারিতা হয়ে ওঠে অসম্ভব প্রাণবন্ত। সেই সঙ্গে তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ তার প্রধান হাতিয়ার। তবু মনে হয় অনেক কিছু গোপন তথ্য তিনি মনের গহিনে লুকিয়ে রেখেছেন। অধিকাংশ সময় কাটে বই পড়ে লেখালিখি করে আর আড্ডা পেলে তো কথাই নেই। আসিফ হাসান নবী ও শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান তার আলাপের প্রিয় সঙ্গী। কোনো সীমিত পরিসরে হারুনের কর্মবহুল ও বৈচিত্র্যময় জীবনের বৃত্তান্ত আঁকা এক কথায় অসম্ভব। আবদুল্লাহ আল-হারুন মানেই সংগ্রামী জীবন-সংগ্রামের জীবন। আপসহীন, অসীম সাহসী এক পুরুষ। 


শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, প্রাবন্ধিক ও গবেষক; অফিসার , বাংলা একাডেমি






সূত্র: /সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশ্যে আপোষহীন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top