সেবা ডেস্ক: দেশজুড়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার পারদ এখন তুঙ্গে। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখন ‘খুব ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে’।
![]() |
| ভেন্টিলেশনে খালেদা জিয়া: পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে, যেকোনো সময় দুঃসংবাদের শঙ্কা? |
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের চারদেয়ালের মাঝে চলছে তার বেঁচে থাকার এক অসম লড়াই। আজ সোমবার দুপুরে হাসপাতাল চত্বরে এক হৃদয়বিদারক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে গোটা জাতি স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। তিনি জানিয়েছেন, বেগম জিয়া এখন অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে বা সংকটজনক অবস্থায় রয়েছেন। তাকে ভেন্টিলেশন বা লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে পরিস্থিতি এখন এতটাই জটিল যে, মহান আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছেন না তার পরিবার ও দলের নেতাকর্মীরা।
সোমবার বেলা পৌনে দুইটার দিকে হাসপাতালের সামনে যখন আহমেদ আজম খান গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন, তখন তার কণ্ঠে ছিল গভীর হতাশা আর চোখের কোণে ছিল অশ্রুর আভাস। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, গতকাল রোববার রাত থেকেই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটতে শুরু করে। আজ সোমবার তা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘ভেরি ক্রিটিক্যাল’ বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, ম্যাডাম খুব ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে চলে গেছেন। তিনি আমাদের মাঝে ফিরে আসার জন্য ফাইট করছেন। কিন্তু সত্যি বলতে, বলার মতো কোনো ইতিবাচক অবস্থায় তিনি এখনো আসেননি। সারা জাতির কাছে দোয়া চাওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু বলার নেই। এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
খালেদা জিয়ার বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে এই বিএনপি নেতা জানান, বর্তমানে খালেদা জিয়া ভেন্টিলেশন সাপোর্টে আছেন। সাধারণ মানুষের বোঝার সুবিধার্থে তিনি ব্যাখ্যা করেন, সিসিইউ থেকে আইসিইউ, এরপর ভেন্টিলেশন বা লাইফ সাপোর্ট—চিকিৎসার এই ধাপগুলো অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। তিনি যা-ই বলেন না কেন, মূল কথা হলো ম্যাডাম এখন জীবন-মৃত্যুর দোলচলে। কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যবস্থার মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রাখার এক প্রাণান্তকর চেষ্টা চলছে। ৭৮ বছর বয়সী এই প্রবীণ রাজনীতিবীদের শরীরে বাসা বেঁধেছে লিভার সিরোসিস, কিডনি জটিলতা, হৃদরোগ ও ফুসফুসের সংক্রমণসহ নানা দুরারোগ্য ব্যাধি। এই বয়সে এসে এতগুলো রোগের সঙ্গে লড়াই করা যেকোনো মানুষের জন্যই অসম্ভবপ্রায়, আর সেখানেই চিকিৎসকরা তাদের সর্বোচ্চ মেধা ও শ্রম বিনিয়োগ করছেন।
বেগম জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। আহমেদ আজম খান জানান, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছিল। জন হপকিন্সসহ বিশ্বের নামকরা হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়মিত জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে তার চিকিৎসার গতিপথ নির্ধারণ করা হতো। তবে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় এখন চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন। দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত এই বোর্ড ক্লান্তিহীনভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবুও আহমেদ আজম খানের কণ্ঠে ছিল অসহায়ত্বের সুর। তিনি বলেন, সবাই মিলে ক্লান্তিহীনভাবে চেষ্টা করছেন, কিন্তু বাদবাকি আল্লাহ ভরসা। এই একটি বাক্যেই ফুটে উঠেছে পরিস্থিতির গভীরতা। যখন বিজ্ঞান ও চিকিৎসা ব্যবস্থা তার শেষ সীমায় পৌঁছে যায়, তখন মানুষ কেবল অলৌকিক কিছুর প্রত্যাশায় থাকে।
গত ২৩ নভেম্বর রাতে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বিএনপি চেয়ারপারসন। শ্বাসকষ্ট ও জ্বরের কারণে তাকে জরুরি ভিত্তিতে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শুরুতে কেবিনে রাখা হলেও শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে দ্রুত করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি হাসপাতালেই শয্যাশায়ী। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা নিশ্চিত হন যে, তার ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ বা নিউমোনিয়া দেখা দিয়েছে। লিভারজনিত পুরনো সংকট আর কিডনির কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার কারণে তার শরীরে পানি চলে এসেছে, যা ফুসফুসের সংক্রমণকে আরও জটিল করে তুলেছে। শ্বাসকষ্ট এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছিল যে, স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেওয়া তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় তাকে ভেন্টিলেশনের সহায়তা নিতে হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবারই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন যে, দেশনেত্রীর অবস্থা ‘অত্যন্ত সংকটজনক’। তিনি তখন বলেছিলেন, চিকিৎসকরা তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন কিন্তু শরীরের প্যারামিটারগুলো ওঠানামা করছে। পরদিন শুক্রবার তিনি আবারও জানান, উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম জিয়াকে দেশের বাইরে নেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা এখন আর নেই। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার ধকল সওয়ার মতো শক্তি তার শরীরে অবশিষ্ট নেই। এই ঘোষণার পর থেকেই দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কা দানা বাঁধতে থাকে। আজ আহমেদ আজম খানের বক্তব্যের পর সেই শঙ্কা বাস্তবে রূপ নিল।
হাসপাতালের গেটে এখন নেতাকর্মীদের ভিড়, তবে সেখানে নেই কোনো স্লোগান। আছে কেবল পিনপতন নীরবতা আর চাপা কান্না। দলের শীর্ষ নেতারা থেকে শুরু করে তৃণমূলের কর্মী—সবার চোখেই জল। অনেকেই হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে নফল নামাজ আদায় করছেন, কেউবা তসবিহ জপছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও বইছে শোকের ছায়া। হাজার হাজার মানুষ তাদের প্রিয় নেত্রীর আরোগ্য কামনায় স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির ও উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে অনেকেই সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সুস্থতা কামনা করছেন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে তার পেটে ও ফুসফুসে পানি জমে যাওয়ার প্রবণতা অনেক আগে থেকেই ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডায়াবেটিস ও আর্থ্রাইটিস। কিন্তু এবারের ফুসফুসের সংক্রমণ বা চেস্ট ইনফেকশন তার দুর্বল শরীরের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিডনি ঠিকমতো কাজ না করায় শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের হতে পারছে না, যা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিকল করে দিচ্ছে। মাল্টিপল অর্গান ফেইলিউরের দিকে ধাবিত হওয়ার এই প্রক্রিয়াই চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ। ভেন্টিলেশনে রাখার অর্থ হলো, তার ফুসফুস এখন নিজে থেকে অক্সিজেন নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে বা খুবই কম কাজ করছে। যন্ত্রের সাহায্যে অক্সিজেন সরবরাহ করে হার্ট ও অন্যান্য অঙ্গ সচল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী বর্তমান চিকিৎসা প্রোটোকল সাজানো হয়েছে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, এই মুহূর্তে তাকে কোনোভাবেই মুভ করা বা বিদেশে নেওয়া সম্ভব নয়। তাকে স্থিতিশীল বা স্টেবল কন্ডিশনে ফিরিয়ে আনাই এখন একমাত্র লক্ষ্য। যদি তিনি ভেন্টিলেশন থেকে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে ফিরতে পারেন, তবেই পরবর্তী চিকিৎসার কথা ভাবা যাবে। কিন্তু গত ২৪ ঘণ্টায় তার অবস্থার যে অবনতি হয়েছে, তাতে আশার আলো ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে।
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিলেন। তার এই অসুস্থতা কেবল একটি পরিবারের বা দলের সংকট নয়, এটি জাতীয় রাজনীতির এক বিশাল অধ্যায়। কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। একাধিকবার তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, কিন্তু এবারের মতো এত দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল সংকটে তিনি আগে কখনও পড়েননি। আহমেদ আজম খানের আজকের ব্রিফিং যেন সেই বার্তাটিই পৌঁছে দিল যে, আমরা হয়তো এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি।
সন্ধ্যার পর হাসপাতালের পরিস্থিতি আরও থমথমে হয়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীরা খবরের আশায় ভিড় করছেন। সবার মনে একটাই প্রশ্ন—কী ঘটতে যাচ্ছে? চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো মেডিকেল বুলেটিন এখনো দেওয়া না হলেও, আহমেদ আজম খানের বক্তব্যই পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝার জন্য যথেষ্ট। তিনি যখন বলেন, ম্যাডাম ফাইট করছেন, তখন আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে আইসিইউর বিছানায় শুয়ে থাকা এক মহীয়সী নারীর মুখ, যিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও হার মানতে নারাজ।
এখন অপেক্ষা কেবল সময়ের। মহান সৃষ্টিকর্তার ইশারা ছাড়া চিকিৎসকদের আর কিছুই করার নেই। আহমেদ আজম খানের আকুতি ভরা কণ্ঠস্বর আজ সারাদেশের মানুষের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। দলমত নির্বিশেষে সবাই আজ প্রার্থনা করছেন, যেন কোনো অলৌকিক ঘটনায় তিনি ফিরে আসেন। ভেন্টিলেশনের যান্ত্রিক শব্দের মাঝেও হয়তো তিনি অনুভব করছেন কোটি মানুষের ভালোবাসা। তবে বাস্তবতা বড়ই নির্মম। খুব ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে থাকা বেগম জিয়ার পরবর্তী আপডেট কী আসে, সেদিকেই তাকিয়ে আছে গোটা বিশ্ব। জীবন-মৃত্যুর এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ আজ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রহর গুনছে।
সূত্র: /সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশ্যে আপোষহীন
জাতীয়- নিয়ে আরও পড়ুন

পূর্বাচল প্লট কেলেঙ্কারি: শেখ হাসিনা, রেহানা ও টিউলিপের ভাগ্য নির্ধারণ আজ

ডিসেম্বরের শুরুতেই দুঃসংবাদ, এক লাফে বাড়ল সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম

শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন: কারণ শর্ট সার্কিট, নাশকতার প্রমাণ মেলেনি

শেখ হাসিনার ব্যাংক লকার থেকে ৮৩২ ভরি স্বর্ণালংকার জব্দ

ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত না হয়ে, কী করবেন❓কী করবেন না❓


খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।