নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা | ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, মঙ্গলবার: আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন। দীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পথ বেয়ে অর্জিত লাল-সবুজের পতাকার ৫৪ বছর পূর্ণ হলো আজ।
![]() |
| আজ মহান বিজয় দিবস: বিশ্ব মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ৫৪ বছর |
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন আজ। বীরের জাতি হিসেবে বাঙালির আত্মপ্রকাশের দিন।
১৯৭১ সালে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর কবল থেকে দেশ মুক্ত হওয়ার এই দিনটিকে আজ জাতি গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর উৎসবের আমেজে উদ্যাপন করছে। ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা আজ বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে এক পরম অহংকার।
ভোরের সূর্য উঁকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা। বিজয়ের এই গৌরবময় মুহূর্তকে স্মরণ করে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসের সূচনা হয়। তোপধ্বনির গগনবিদারী শব্দ যেন জানিয়ে দেয়, আমরা হার না মানা জাতি, আমরা বিজয়ী।
ভোর থেকেই সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল নেমেছে। দিনের শুরুতেই সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর শ্রদ্ধা জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে, শহীদদের স্মরণে পালন করা হয় এক মিনিট নীরবতা।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর স্মৃতিসৌধ এলাকা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকরা, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন এবং সর্বস্তরের মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। হাতে লাল-সবুজের পতাকা, কপালে বিজয় দিবসের ব্যান্ড আর হৃদয়ে গভীর ভালোবাসা নিয়ে লাখো মানুষ আজ ছুটে গেছেন সাভারে।
বিশ্ব রেকর্ড গড়ার অপেক্ষায় আকাশ
এবারের বিজয় দিবসের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো আকাশে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার প্রচেষ্টা। মহান বিজয় দিবস দেশব্যাপী জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্যাপনের অংশ হিসেবে আজ সর্বোচ্চসংখ্যক জাতীয় পতাকা নিয়ে প্যারাশুটিং করে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ‘টিম বাংলাদেশ’-এর ৫৪ জন প্যারাট্রুপার আজ সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে পতাকাবাহী স্কাইডাইভ প্রদর্শন করবেন। বিশ্বের ইতিহাসে এটিই হবে সর্ববৃহৎ পতাকা-প্যারাশুটিং প্রদর্শনী। রাজধানীর আকাশ আজ সাক্ষী হবে এক নতুন ইতিহাসের।
এর আগে সকাল ১১টা থেকে রাজধানীর তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী পৃথকভাবে আকর্ষণীয় ফ্লাই-পাস্ট প্রদর্শন করবে। ফাইটার জেটের গর্জন আর আকাশের বুকে নান্দনিক কসরত দেখতে হাজারো মানুষ জড়ো হয়েছেন বিমানবন্দর এলাকায়। সেখানে একটি বিশেষ বিজয় দিবস ব্যান্ড শো-এরও আয়োজন করা হয়েছে।
শুধু ঢাকা নয়, দেশের অন্যান্য বড় শহরেও সশস্ত্র বাহিনীর পরিচালনায় একই রকম ফ্লাই-পাস্ট প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পাশাপাশি পুলিশ, বিজিবি এবং আনসার বাহিনী দেশব্যাপী ব্যান্ড শো আয়োজন করেছে, যা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
মহান বিজয় দিবস নিয়ে আরও পড়ুন:

কাজিপুরে মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে প্রস্তুতিমূলক সভা

আজ মহান বিজয় দিবস

বিজয় দিবস উপলক্ষে জামায়াত ইসলামীর আনন্দ শোভাযাত্রা

বকশীগঞ্জে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিজয় মেলা উদ্বোধন

জামালপুরে বিজয় দিবসে বিএনপির সমাবেশ ও র্যালি
বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ সেজেছে নতুনের কেতন উড়িয়ে। সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলোতে করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন আলোকসজ্জা। সন্ধ্যার পর রাজধানী ঢাকা পরিণত হবে আলোর নগরীতে।
ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলো ইতোমধ্যেই জাতীয় পতাকাসহ ব্যানার, ফেস্টুন এবং রঙিন পতাকা দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাজছে দেশাত্মবোধক গান। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ভাষণ আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানে মুখরিত চারপাশ।
বিজয় দিবসের আনন্দ কেবল রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ নেই। দিবসটি উপলক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের সকল জেলা ও উপজেলায় তিন দিনব্যাপী ‘বিজয় মেলা’র আয়োজন করেছে। এই মেলাগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং গ্রামবাংলার সংস্কৃতি তুলে ধরা হচ্ছে।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসন শিশুদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ওপর আবৃত্তি, প্রবন্ধ রচনা এবং চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং দিবসটি উদ্যাপনের জন্য বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। আজ সকাল ৯টায় দেশের সকল বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেছে। কুচকাওয়াজে অংশ নিয়ে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা দেশপ্রেমের শপথ নিয়েছে।
বিকেলের পর থেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গন হয়ে উঠবে মুখর। আজ বিকেল ৩টা থেকে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে—যেখানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল—সেখানে বিজয় দিবসের বিশেষ গান পরিবেশিত হবে। একই সময়ে দেশের ৬৪টি জেলায় একযোগে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান পরিবেশন করবেন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তথ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করেছে।
সারা দেশের সিনেমাহলগুলোতে আজ শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হচ্ছে। এছাড়া দেশের অডিটোরিয়াম এবং উন্মুক্ত স্থানে মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে তথ্যচিত্র দেখানো হচ্ছে। সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত জাদুঘরগুলো আজ প্রবেশ ফি ছাড়াই সারাদিন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। দেশের সকল বিনোদন কেন্দ্রে শিশুদের জন্য বিনামূল্যে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে, যা শিশুদের জন্য আজকের দিনটিকে আরও আনন্দময় করে তুলেছে।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন আজ বিকেলে বঙ্গভবনে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা জানাবেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই সম্মান প্রদর্শন বীর শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। একইভাবে মহানগর, জেলা ও উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদদের পরিবারের সদস্যদের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে।
মানবতার সেবায়ও আজকের দিনটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। দেশের সকল হাসপাতাল, কারাগার, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা, পথশিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র, প্রতিবন্ধী কল্যাণ কেন্দ্র, ডে-কেয়ার সেন্টার, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র এবং শিশু পরিবার ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে আজ উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার চিরশান্তি, আহত প্রবীণদের সুস্থতা এবং দেশের শান্তি ও অগ্রগতি কামনা করে আজ জুমার নামাজের পর মসজিদগুলোতে এবং অন্যান্য সময় মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।
নৌ-জাহাজ পরিদর্শন ও স্মারক ডাকটিকিট
সাধারণ মানুষের কৌতূহল মেটাতে আজ দেশের বিভিন্ন বন্দরে নৌবাহিনীর জাহাজগুলো উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা এবং পায়রা বন্দর, ঢাকা সদরঘাট, পাগলা এবং বরিশালসহ বিআইডব্লিউটিসি জেটিতে সকাল ৯টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের জাহাজগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। শিশুরা বাবা-মায়ের হাত ধরে উৎসাহ নিয়ে দেখছে দেশের জলসীমা রক্ষাকারী এই বিশাল যুদ্ধজাহাজগুলো।
এছাড়া বাংলাদেশ ডাক বিভাগ এই মহান দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বিশেষ স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও রেডিও স্টেশনগুলো দিনভর মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যে বিজয়ের সূচনা হয়েছিল, তা আজ ৫৪ বছরে পদার্পণ করল। রাজনৈতিক নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। তবে বিজয়ের এই দিনে জাতির প্রত্যাশা—বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক এবং সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ার। যে স্বপ্নের কথা বলে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নতুন প্রজন্ম আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিজয়ের আনন্দ আর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধায় আজ একাকার গোটা বাংলাদেশ।
সূত্র: /সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশ্যে আপোষহীন
জাতীয়- নিয়ে আরও পড়ুন

ভেন্টিলেশনে খালেদা জিয়া: অবস্থা সংকটাপন্ন, চলছে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়াই

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট

আজ সন্ধ্যা ৬টায় জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা

আগামীকাল সন্ধ্যা ৬টায় জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা

তফসিল ঘোষণার ঠিক আগেই পদত্যাগ করলেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ


খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।