সাংবাদিককে হত্যার হুমকি, সিঙ্গাইর ছাত্রলীগ সম্পাদক রমিজ বহিস্কার

G M Fatiul Hafiz Babu
মোঃ মোবারক হোসেন:



বহু অপকর্মের হোতা মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক রমিজ উদ্দীনকে অবশেষে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। দৈনিক যায়যায়দিনের সাংবাদিক মোবারক হোসেনকে হত্যার হুমকি ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তাঁকে ছাত্রলীগের সকল কর্মকা- থেকে অব্যাহতি দেয় জেলা ছাত্রলীগ। সেই সাথে যুগ্ম-সম্পাদক শাহীনুর রহমান শাহীনকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধায় জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাদিকুল ইসলাম সোহা ও সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক রুবেলের স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।
এদিকে ছাত্রলীগ নেতা রমিজ উদ্দীননের বহিস্কারের খবর শুনে দলীয় নেতাকর্মী ও সর্বস্তরের জনসাধারণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। খুশিতে অনেকেই একে অপরকে মিষ্টি খাওয়ান। 

রমিজ উদ্দীন সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে উঠে। অভিযোগ উঠে মাদকব্যবসা, জবর দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সরকারী টাকা আত্মসাৎ, নিরাপরাধ মানুষকে মারধরসহ নানা ধরণের অপকর্মের। তাঁর অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছিলনা সাংবাদিকসহ নিজ দলের কর্মী সমর্থকরাও। একের পর এক অঘটন ঘটিয়ে সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হন তিনি। এতে ছাত্রলীগ তথা আওয়ামীলীগের ভাবমুর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে রমিজ উদ্দীনকে গত ১৪ মে সাময়িক বহিস্কার করে জেলা ছাত্রলীগ। এরপরও থামছিলনা তাঁর অপরাধের মাত্রা। সম্প্রতি অপকর্মের সংবাদ প্রকাশ করায় গত ১৯ জুন দৈনিক যায়যায়দিনের সাংবাদিক মোবারক হোসেনকে লাঞ্চিত ও হত্যার হুমকি দেন রমিজ উদ্দীন। এসব বিতর্কিত ও সংগঠন বিরোধী কর্মকা-ে তাঁর বিরুদ্ধে ফুসে উঠে নিজ দল আওয়ামীলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈিতক ও পেশাজীবি সংগঠন। বহিস্কার ও গ্রেফতারের দাবি জানান এসব সংগঠনের নেতারা। এরই প্রেক্ষিতে জেলা ছাত্রলীগ গত বৃহস্পতিবার বিকালে এক জরুরী সভা ডাকে। ওই সভায় সর্ব সম্মতিক্রমে রমিজ উদ্দীনকে উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেন। সেই সাথে যুগ্ম-সম্পাদক শাহীনুর রহমান শাহীনকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ত্ব দেয়া হয়। 

সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়ে রমিজ উদ্দীন সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে গোটা উপজেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। গড়ে তুলে মাদকের বিশাল সম্রাজ্য। দলীয় প্রভাব ও ছাত্রলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে অল্প সময়ে তিনি মাদকব্যবসা ও অবৈধ উপায়ে কয়েক কোটি টাকার মালিক বনেযান। পরিচিতি পায় ইয়াবা সম্রাট হিসেবে। তাঁর অপকর্মে বিব্রত হয়ে স'ানীয় সাংসদ কন্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম ও দলের শীর্ষ নেতারা একাধিকবার সতর্ক করলেও তিনি তাঁর অপরাধের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেন। টাকার জন্য এমন কোনো জগণ্য কাজ নেই যা তিনি করতেন না। তাঁর সংগঠন বিরোধী কর্মকা- ও অন্যায় অত্যাচারে ভাবিয়ে তুলে এমপি মমতাজ বেগমমহ ও দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে। এমনকি রমিজকে সংগঠন থেকে বহিস্কার না করলে পদত্যাগ করার হুমকিও দেন অনেক ত্যাগী ছাত্রলীগ নেতা।

এদিকে গত ১০ মে রমিজ উদ্দীন মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পৌর বাজারে ২০ টি অটোরিক্সা ভাংচুর ও চালকদের মারধর করে তাঁড়িয়ে দেন। এ ঘটনায় দৈনিক যায়যায়দিন ও সাপ্তাহিক গণচেতনাসহ স'ানীয় এবং জাতীয় বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে তাঁকে সাময়িক বহিস্কার করে জেলা ছাত্রলীগ। এতে সাংবাদিক মোবারক হোসেনসহ অন্যান্য গণমাধ্যমকর্মীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে রমিজ উদ্দীন। গত ১৯ জুন রাত ৯ টার দিকে মোবারক সিঙ্গাইর বাজার থেকে পৌরসভার আঙ্গারিয়া মহল্লার বাসায় ফিরছিলেন। উপজেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে পৌছলে রমিজ উদ্দীন মদ্যপ অবস'ায় মোবারককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও হত্যার হুমকি দেন। এ ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করে রমিজ উদ্দীনকে বহিস্কার ও গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন সমাজের বিশিষ্ঠ ব্যক্তিরা।

রমিজ উদ্দীনের যত অপকর্ম:
সংবাদ প্রকাশের জের ধরে গত ১৯ জুন রমিজ উদ্দীন মদ্যপ অবস'ায় জাতীয় দৈনিক যায়যায়দিনের সাংবাদিক মোঃ মোবারক হোসেনকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও হত্যার হুমকি দেন। এরআগে ১০ জুন সিগারেটের টাকা চাওয়ায় সিঙ্গাইর পৌর বাজারের দানেজ নামে এক দোকানিকে দুই দফা পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠায় রমিজ উদ্দীন। ১০ মে এই নেতা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ২০ টি অটোরিক্সা ভাংচুর  ও চালকদের মারধর করে সিঙ্গাইর বাজার থেকে বেড় করে দেয়। একই মাসের ১৩ মে গভীর রাতে সিঙ্গাইর-হেমায়েতপুর সড়কের আজিমপুর নতুন ব্রীজ এলাকায় অসৎ উদ্দেশ্যে একটি মাল বোঝাই ট্রাকে হামলা করে রমিজ উদ্দীন ও তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী। এসময় উপজেলার মেদুলিয়া গ্রামের আরিফ নামে এক রেন্টকার ব্যবসায়ী তাঁর আত্মীয়ের জানাজা পড়ে পরিবার নিয়ে ওই স'ান দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তাদের চিনে ফেলায় গাঁড়ি ভাংচুর  ও কারও কাছে এঘটনা না বলতে আরিফকে স্বাসিয়ে দেয়। চলতি বছর উপজেলার বাইমাইলে বৈশাখি মেলায় স্বপন নামের এক আওয়ামীলীগকর্মী পাওনা টাকা চাওয়ায় রমিজ উদ্দীন কোমর থেকে পিস্তল বেড় করে তাকে গুলি করার হুমকি দেন। এসময় হুড়োহুড়িতে পিস্তলের কয়েক রাউন্ড গুলি খোয়া যায় বলে জানান প্রত্যেক্ষদর্শীরা। এর কিছুদিন আগে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তার সাথে একটি সিগারেট কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধির বচসা হয়। পরে তাকে পা ধরে মাপ চাইতে বাধ্য  ও শারীরিক ভাবে লাঞ্চিত করেন রমিজ উদ্দীন। গেল বছরের শেষের দিকে বিপুল পরিমান মাদকসহ রমিজ উদ্দীন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আটক হয়। তখন ক্ষমতার প্রভাব ও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ছাড়া পান তিনি। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর রমিজ উদ্দীনের বাড়ি থেকে দেশের চাঞ্চল্যকর বিশ্বজিৎ হত্যাকা- মামলার ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামী মাহফুজুর রহমান নাহিদ গ্রেফতার হয়। এসময় তাঁকেও আটক করা হয়েছিল। পরে স'ানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে রমিজকে ছাড়িয়ে রাখেন। এ সংবাদটি পরের দিন ১৩ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা প্রধান শিরোনাম করে। সংবাদটি অন্যান্য পত্রিকাও গুরুত্ব সহকারে ছাপে। একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর উপজেলার জয়মন্টপ পৌষ মেলায় মদ খেয়ে মাতলামী করায় গণধোলাইয়ের শিকার হন রমিজ উদ্দীন। পরে রমিজ ও তার বাহিনী জয়মন্টপ বাসষ্টা- বে্যাপক তা-ব চালায়। ভাংচুর করে স'ানীয় যুবলীগ নেতা সেলিম মিয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ খবরটিও ২৯ ডিসেম্বর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এছাড়া এই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে মাদকব্যবসা, টেন্ডারবাজি, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের অর্থ আত্মসাতসহ ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে তথ্য প্রমানসহ ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রকাশ করা হবে।

জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাদিকুল ইসলাম সোহা বলেন, সাংবাদিক মোবারক হোসেনকে প্রাণ নাশের হুমকি ও রমিজ উদ্দীনের নানা অপকর্মের কারণে ছাত্রলীগ তথা আওয়ামীলীগের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয়। একাধিকবার সতর্ক করার পরও সংশোধন না হওয়ায় তাঁকে উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে  স'ায়ী ভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়।

উপজেলা আওয়ামীলীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, রমিজ উদ্দীনের বেপরোয়া কর্মকান্ডে সাংসদ মমতাজ বেগমসহ দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী বিব্রত ছিল। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে নিজেকে মহারাজা ভেবে যা ইচ্ছা তাই করত। তিনি কারও বাঁধা নিষেধ মানেননি। এজন্য আজ তাঁর এই পরিনিতি। রমিজের বহিস্কারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভাবমুর্তি উজ্জল হয়েছে বলে জানান এসব নেতারা ।

পুলিশ পরিদর্শক (ওসি) সৈয়দুজ্জামান জানান, ছাত্রলীগ নেতা রমিজ উদ্দীনের বিষয়ে খোজ খবর নেয়া হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় তাঁর জড়িত থাকার প্রমান পাওয়া গেছে। এছাড়া সাংবাদিক মোবারক হোসেনকে প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগটি খতিয়ে দেখে তাঁকে আইনের আওতায় আনা হবে।

এ বিষয়ে কথা বলতে রমিজ উদ্দীনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও  তিনি ফোন ধরেননি।

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top