ত্রপা
মজুমদার। একজন গুণী, দক্ষ, সৃজনশীল অভিনেত্রী ও নাট্য নির্মাতা। তার বাবা
নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, মা মঞ্চ ও টেলিভিশনের কিংবদন্তি
অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। সাংস্কৃতিক বাতাবরণে এই শিল্পী বেড়ে উঠেছেন এক
নিরাভরণ আবহে। তার সাথে কথা বলে উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরেছেন পীযূষ সিকদার
ছোট
থেকেই তো একটি সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছেন, একজন রামেন্দু মজুমদার আপনার
পিতা এবং একজন ফেরদৌসী মজুমদার আপনার মা—এঁদেরকে কীভাবে দেখেন?
আমি
অনেক সৌভাগ্যবান যে আমি আমার বাবা-মায়ের মতো শিল্প অনুরাগী বাবা-মা
পেয়েছি। আমি যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই শিল্পের প্রতি আমার অদম্য
আকর্ষণ অনুভব করি। তারই সূত্র ধরে গান শিখি, তানপুরায় আঙুল চালাই। গান আমি
ভালোবাসি কিন্তু গান আমার শেখা হয়নি, বলতে পারেন কঠিন মনে হয়েছে। এই যে
শিখবার অদম্য আগ্রহ তা আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি। আমার বাবা-মায়ের
কাছে যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি বিনা বাধায়। তাদের কাছে পড়াশোনাটা প্রথম। মা
কখনো
শিশু শিল্পী পছন্দ করতেন না। মা মনে করেন শিল্পী হতে গেলে যে বোধের দরকার
যে পড়াশোনা করা দরকার শিশু বয়সে ওই বোধের জন্ম হয় না। তাই তো নাটক আমাকে
টানলেও মা-বাবার কথামতো আমাকে নাটকে কাজ করতে এইচএসসি পাস করে শুরু করতে
হয়েছে। আসলে সকল মা-বাবাই যার যার কাছে তার তার আদর্শ বাবা-মা। আমার
বাবা-মা অতি সাধারণ ভঙ্গি নিয়ে এক অসাধারণ বাবা-মা হয়ে আছেন আমার কাছে।
এইচএসসি পাস করে কোথায় ভর্তি হলেন? থিয়েটারটা কিভাবে শুরু করলেন?
আমি
এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে
ভর্তি হই। একই সাথে থিয়েটার স্কুল থেকে কোর্স করে থিয়েটারে যোগ দিই। আসলে
আমার জীবনটা সৌভাগ্য দ্বারা বারিত। বলতে পারেন সৌভাগ্যের মানসকন্যা। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এমএ করে ওই বিভাগেই প্রভাষক পদে যোগ দিই।
আসলে শিক্ষকতা পেশা এনজয় করতে পারিনি বিধায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি আমি
ছেড়ে দিই। তারপর নিজেদের ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হই। আমি কোনো কাজে এত
প্যাশন বোধ করি না যতটা থিয়েটারের প্রতি আমার প্যাশন রয়েছে। আমার মনে হয়,
আমি যে পরিবারে জন্মেছি, সে পরিবারে না জন্মালেও আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি
থিয়েটারই করতাম।
অনেকে মনে করেন থিয়েটারটা উচ্চবিত্তের হাতে চলে গেছে। আপনি কী মনে করেন?
সত্যি
কথা হলো, থিয়েটার কখনোই তৃণমূলের হাতে ছিল না। থিয়েটারটা হয় কিছু সিলেকটিভ
মানুষের দ্বারা এবং সিলেকটিভ কিছু দর্শকের সমন্বয়ে। আর থিয়েটার করাটা অত
এক্সপেনসিভ নয়। ইচ্ছে শক্তি প্রবল থাকলে নিম্ন আয়ের মানুষও থিয়েটার করতে
পারেন। দেখতে পারেন।
অনেকে মনে করেন থিয়েটারের বয়স দুইশ বছর কি তার কিছু বেশি। আবার অনেকে মনে করেন নাটকের ইতিহাস হাজার বছরের। আপনি কী মনে করেন?
আমি
এসব নিয়ে ভাবি না। আগামী দুইশ বছরে থিয়েটার কেমন হবে বলতে পারি। আমাদের
থিয়েটারের মূল সমস্যা দর্শক। দর্শক যদি থিয়েটার দেখে তাহলে আমাদের থিয়েটার
এগিয়ে যাবে।
দর্শক থিয়েটার দেখে না—এর প্রধান কারণ কী?
আমার
কাছে মনে হয় দর্শকশূন্যতার এক নম্বর কারণ জ্যাম। সারাদিন অফিস করে ব্যবসা
করে ঢাকার জ্যাম মারিয়ে থিয়েটার দেখতে আসার ইচ্ছেটা মরে যায়। আরেকটা কারণ
মানহীন নাটক। একজন প্রথম থিয়েটার দেখতে এলো, সে যদি একটি খারাপ নাটক দেখে
তাহলে তার টোটাল থিয়েটার নিয়ে একটা নেগেটিভ ভাবনা জন্মে। আরেকটা কারণ যদি
বলতে যাই তাহলো আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা। সে একাই সবকিছু করতে ভালোবাসে।
থিয়েটার যেহেতু একা হয় না কিছু সংখ্যক অভিনেতা-অভিনেত্রী লাগে। লাগে কিছু
দর্শক। ওই দর্শক যদি আত্মকেন্দ্রিক হয় তাহলে সে সমষ্ঠির মধ্যে আসতে চায় না।
শেষে বলতে চাই, নাটকের মানটাকে যদি আমরা ধরে রাখতে পারি তাহলে দর্শক আসবে
থিয়েটার দেখতে। আমার মনে হয়, যেকোনো দল নাটক করতে চাইলেই তাকে প্রদর্শনের
সুযোগ না দিয়ে একটি কমিটির মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে মানসম্পন্ন নাটককে
প্রদর্শনের ছাড়পত্র দেওয়া উচিত। অবশ্যই নাট্যকর্মীকে থিয়েটারে
পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।
আপনি মঞ্চ ও টেলিশনের একজন দক্ষ অভিনেত্রী। নাটকও নির্দেশনা দিয়ে চলেছেন। কী কী নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন?
এই
প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ আল মামুনের কথা বলতেই হয়। তিনি এক সময় দল নিয়ে চিন্তিত
হয়ে পড়লেন, আমি না থাকলে নাটক রচনা ও নির্দেশনা কে দেবে! তাই তিনি
থিয়েটারের নতুন কর্মীদের নিয়ে একটি এক্সপেরিমেন্টাল প্রযোজনার কথা বললেন।
জগলুল আলম নাটক লিখলেন ‘ছয় বেহারার পাল্কি’। এভাবে একে একে আমেরিকান নাটক
অনুবাদে মুক্তি, পান্থ শাহরীয়ারের বারামখানা, মাসুম রেজার কুহকজাল নাটক
আমার নির্দেশনায় মঞ্চে আসে।
অভিনয়ের মূল সূত্রটা কী একজন অভিনেত্রী হিসেবে আপনার কাছে?
একজন
অভিনেতার সূক্ষ্ম অনুভূতি থাকতে হবে। যাতে করে সে চরিত্র ধারণ করতে পারে
এবং চরিত্রের আবেগ দর্শকের সাথে একাত্মতায় প্রকাশ করতে পারে। দর্শক যদি
অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে হাসে এবং কাঁদে তাহলে বুঝতে হবে সেখানেই অভিনয়টা
হলো।