বিমান হইতে নিম্নে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের দিকে তাকাইলে দেখা যাইবে নদ-নদী
আর ছোট-বড় অসংখ্য জলাধারের ওপরে যেন দেশটি ভাসিতেছে। অথচ এই দেশের ২ কোটি ৮
লক্ষ মানুষ এখনও নিরাপদ পানি পায় না। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম (জেএমপি) ‘স্যানিটেশন ও সুপেয় পানি
খাতে অগ্রগতি: এমডিজি মূল্যায়ন ২০১৫’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের
সদস্য রাষ্ট্রগুলির পানি ও স্যানিটেশন খাতে অগ্রগতির এই চিত্র তুলিয়া
ধরিয়াছে। বাংলাদেশের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি)-২০১৫ সনের
মধ্যে ৮৫ শতাংশ মানুষের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা-সফলভাবেই অর্জিত হইয়াছে।
তবে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে ১৩ শতাংশ মানুষ এখনও অনিরাপদ পানি পান করে।
১৯৯০ সনে এই হার ছিল ২৬ শতাংশ। এই অগ্রগতি সামান্য নহে। জেএমপি অবশ্য
স্যানিটেশন খাতে বাংলাদেশের অর্জনের প্রশংসা করিয়াছে। ১৯৯০ সনে বাংলাদেশের
৩৪ শতাংশ লোক উন্মুক্ত জায়গায় মলত্যাগ করিলেও এখন করে মাত্র ১ শতাংশ মানুষ।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে শ্রীলঙ্কার পরই বাংলাদেশের অবস্থান।
পানি ও স্যানিটেশনের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় সরকার বিভাগ অবশ্য জেএমপি’র
বক্তব্য মানিতে নারাজ। শতভাগ মানুষই নিরাপদ পানি পাইতেছে বলিয়া তাহাদের
দাবি। তবে জেএমপি’র বক্তব্য খণ্ডাইবার উপায় নাই। পানি ও স্যানিটেশন বিষয়ে
বৈশ্বিক সংস্থাগুলির মধ্যে তাহারাই শ্রেষ্ঠ। বিশ্বে এখনও প্রায় ১১০ কোটি
মানুষ নিরাপদ পানি পায় না। জাতিসংঘ বলিতেছে, বর্তমানে পানির অপব্যবহার একটি
বড় সমস্যা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকিলে ২০৩০ সাল নাগাদ
পৃথিবীতে ৪০ শতাংশ পানির ঘাটতি দেখা দিবে। এইদিকে, আমাদের দেশের প্রায়
৭শ’টি নদী ও শাখা নদী, ৯৮ হাজার হেক্টর জলাধার এবং ২৪ হাজার কিলোমিটারের
অধিক নদী-নালার একটি বিরাট অংশ হয় শুকাইয়া, না হয় ভরাট হইয়া গিয়াছে। এই
অবস্থায় ভূগর্ভস্থ পানির উপরে চাপ বাড়িয়াছে। সমগ্র দেশে ব্যবহূত মোট পানির
৯৫% আসে ভূ-গর্ভ হইতে। দেখা যাইতেছে, বিশ্বের সর্বাধিক ভূগর্ভস্থ পানি
উত্তোলনকারী ১৫টি দেশের মধ্যেও বাংলাদেশ আছে। বস্তুত, নিম্নগামী ভূ-গর্ভ
পানির স্তরের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান আর্সেনিক সমস্যা, দক্ষিণাঞ্চলে
লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নানাবিধ দূষণ এবং জলবায়ুর প্রভাবে মানুষের জন্য নিরাপদ
পানির ব্যবস্থা উদ্বেগের বিষয় হইয়া উঠিয়াছে।
ভূ-পৃষ্ঠের
যেমন ৭০ ভাগই পানিতে ঢাকা, তেমন আমাদের শরীরেরও প্রায় ৭০ ভাগ পানি। শুধু
আমাদের জীবনই নহে, পৃথিবীর সকল জীবজন্তু, কীট-পতঙ্গ, গাছপালা সবকিছুর জীবনই
পানির ওপর নির্ভরশীল। নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট কেবল আমাদের নহে,
বিশ্বব্যাপীই ইহা একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। দেশে দেশে যুদ্ধবিবাদও বাধিতেছে
পানির উেসর ওপর দখলদারিত্ব নিয়া। এখনো বাংলাদেশের নদীবাহিত পানির পরিমাণ
প্রায় ১০১০ কি.মি. এবং বাত্সরিক গড় বৃষ্টির পরিমাণ প্রায় ২০৫০ মিলিমিটার।
এই সকল বিশুদ্ধ পানির উত্স নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন
যেমন প্রয়োজন; তেমনই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের উদ্যোগ ও উত্সাহদান
করিতে হইবে। অথচ দেখা যাইতেছে, পানি ও স্যানিটেশন খাতে কিছু অর্জন হওয়ায়
সরকারের মধ্যে আত্মতুষ্টি দেখা দিয়াছে, ফলে দিনে দিনে খাত দুইটিতে বরাদ্দও
কমিতেছে। আমরা এই ব্যাপারে সর্বপক্ষের সতর্ক মনোযোগ আশা করিব।