বারী সিদ্দিকীর বাঁশির সুরে, গানের কথায় যে আবেগ মিশে রয়েছে চীনের ইউনান আর্টস ট্রুপের বাঁশির (হুলুসি) সুরের দোলাতেও মানুষের মনের আবেগের তরঙ্গই প্রকাশ পায়। আন্তর্জাতিক ফোক ফেস্টিভ্যালে বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশনার মাঝেও একটি ঐক্যই ফুটে উঠছিল- তা হলো নানান দেশ, সংস্কৃতির ভিন্নতা থাকলেও হাসি-কান্নার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য নেই ভালোবাসা প্রকাশে, বিরহে ও স্বপ্ন বোনায়। বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের পরিবেশনায় মাটি ঘনিষ্ঠ মানুষের আনন্দ, যন্ত্রণা ও ভালোবাসার কথাই ফুটে উঠলো।
গতকাল মেরিল নিবেদিত ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক ফোক ফেস্ট’ এ দ্বিতীয় দিন মানুষের ঢল নেমেছিল। প্রথম দিন ৩৫ হাজার দর্শক প্রবশে করেছিল, গতকাল সে সংখ্যা ছাপিয়ে গিয়েছিল। উত্সব মাতাতে শুরুতেই মঞ্চে ওঠেন বাউলিয়ানার শিল্পীরা। নবীণ শিল্পীদের মন মাতানো সুরে মাতে শ্রোতারা। মঞ্চে ওঠেন নাশিদ কামাল, আজগর আলিম, জহির আলিম এবং নূরজাহান আলিম। বারী সিদ্দিকীর করুণ গানে বিষাদ ছড়িয়ে পড়ে অনুষ্ঠানস্থল জুড়ে। তরুণ প্রজন্মের একজন হয়ে লোক সংগীতের গান শোনায় অর্ণব এন্ড ফ্রেন্ডস। মমতাজ বেগম মঞ্চে উঠলে আয়োজন পায় ভিন্ন একটি রূপ। তার মন মাতানো গান উপভোগ করতে জড়ো হয় দর্শকরা।
দর্শকরা বিপুল করতালি দিয়ে স্বাগত জানায় ভারত থেকে আসা খ্যাতনামা শিল্পী পবন দাস বাউল এবং চীনের ইউনান আর্ট ট্রুপ এর সদস্যদের। তারা কেউই আশাহত করেননি দর্শকদের। তাদের পারফর্মেন্স এর সময় দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালিতে ভরে যায় উত্সবস্থল।
শুরুতেই মঞ্চে আসেন কুষ্টিয়ার বাউল ভজন ক্ষ্যাপা। শিল্পী দরাজ কণ্ঠে প্রথমেই গেয়ে শোনান কাওয়ালি– ‘গুরু গো এ ভব কারাগার/করিতে পারাবার/তুমি গুরু আমার পাড়ের কান্ডারি’। প্রথম গানেই আসর মাত। তুমুল হাততালিতে দর্শকশ্রোতারা অভিনন্দন জানায় শিল্পীকে। এরপর আবারও উন্মাতাল সুরের ঢেউ। এবার তিনি পরিবেশন করেন দেড়শো বছরের প্রাচীন কোনো এক লোককবির গান ‘ও মন রে কেন ডুব দিলে না পাক-দরিয়ায়’। সুর থামতেই মঞ্চে আসেন এদিনের সংগীতানুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রখ্যাত নজরুল সংগীত শিল্পী শাহীন সামাদ।
তারপর দর্শকদের মাতাতে মঞ্চে আসেন ম্যাজিক বাউলিয়ানার নির্বাচিত পাঁচ তরুণ শিল্পী। আয়েশা জেবীন দিপা, বিউটি খাতুন, দিতি সরকার, মরিয়ম আখতার কণা ও মাসুমা সুলতানা সাথী। তাদের প্রথম পরিবেশনা ছিল ‘কি দিয়ে জুড়াই বলো সখী’। বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমের বিখ্যাত গান ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইছে/কেমন দেখা যায়/আরে ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্ক্ষী নাও’ পরিবেশন করেন দ্বিতীয় পরিবেশনাতেই।
উত্সবের এ পর্যায়ে ছিল কিছু আনুষ্ঠানিকতা। প্রধান অতিথি ছিলেন ইমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বিশেষ অতিথি ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সান ইভেন্টস ও মাছরাঙা টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, সব দেশেই লোকসংস্কৃতি ও শহুরে সংস্কৃতির ধারা পাশাপাশি বিরাজমান। মূলত লোকসংস্কৃতি প্রান্তিকমানুষের, অন্যদিকে শহুরে সংস্কৃতি নাগরিক শ্রেণির। এই দুই ধারার মধ্যে রয়েছে ব্যবধান। শহুরে সংস্কৃতি কিছুটা উন্মুল হলেও লোকসংস্কৃতির মূল আমাদের মাটির গভীরে প্রোথিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম সবশ্রেণির মানুষের কাছে নিয়ে এসেছেন। বিশ্ববাসীর কাছেও তুলে ধরেছেন এ সংগীতের মর্মকথা। আমরাও সেই ঐতিহ্যকে অনুসরণ করছি।
পঙ্কজ শরণ বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠছে ঢাকা। এর কারণ এ দেশের মানুষের আত্মায় রয়েছে শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা। নতুন বাংলাদেশের পরিচয়কে তুলে ধরছে এই সংস্কৃতি। এমন একদিন আসবে বিশ্ব সংগীতাসরে এ দেশের শিল্পীরা প্রমাণ করবে।
অঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘মেরিল নিবেদিত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট এর প্রথম দিনে ভিড় করেছে ৩৫ হাজার দর্শক। এতেই বোঝা যায় লোকসঙ্গীতের প্রতি মানুষের সে কি প্রবল আগ্রহ। আয়োজনটি সফল হতে যাচ্ছে। সবাই আন্তরিক হলেই লোকসঙ্গীতকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা সম্ভব।’
এরপর গান শোনাতে আসেন বাংলাদেশের শিল্পী রুবা। ‘বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না’ ছিল রুবার প্রথম পরিবেশনা। এরপর তিনি পরিবেশন করেন ‘কমলায় নৃত্য করে চমকিয়া চমকিয়া’। পরিবেশনা শেষে স্বপ্নীল সজীব স্টেজে এসেই প্রথমে পরিবেশন করেন ‘তুমি কোনবা দেশে রইলারে দয়াল চান’।
উত্সবের তৃতীয় দিন আজ শনিবারও অনুষ্ঠান বিকেল ৫ টা থেকে শুরু হয়ে রাত ১ টা পর্যন্ত চলবে। এ দিন মঞ্চে থাকবেন আবিদা পারভীন, লুবনা মরিয়ম ও সাধনা ডান্স গ্রুপ, ইসলাম উদ্দিন কিস্সাকার, জলের গান, নিয়াভ নি কারা, পার্বতী বাউল, ইন্ডিয়ান ওশেন, কাঙ্গালিনী সুফিয়া এবং হামিরা থেকে মাঙ্গানিয়ারস।