বাঁশখালী উপকূলে জেলে পাড়ার কান্না আজোও থামেনি

S M Ashraful Azom
বাঁশখালী উপকূলে জেলে পাড়ার কান্না আজোও থামেনি
৩১ জেলে হত্যার ৪ বছর গড়ালেও ধরাছোঁয়ার বাইরে জলদস্যুরা


coast of Banskhali coast have not stopped even today

শিব্বির আহমদ রানা, বাঁশখালী প্রতিনিধি: চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী একটি অঞ্চল। ভূগোলিক কারণেই উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ সাগরে মৎস্য আহরণের সাথে জড়িত। বিশেষ করে ছনুয়া, গন্ডামারা, সরল, বাহারছড়া ও খানখানাবাদ ইউনিয়ন বাঁশখালীর উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও শেখেরখীল, শীলকূপ ও কাথারিয়ার কিছু এলাকা উপকূলীয় অঞ্চলে পড়েছে। তবে খানখানাবাদ, বাহারছড়া, গন্ডামারা, সরল ও ছনুয়ার পশ্চিম অংশে এলাকা জুড়ে রয়েছে বিশাল সমুদ্র সৈকত। 

এ উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্য সম্পদের উপর নির্ভরশীল। জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করেই জীবন চলে এখানকার জেলেদের। এই জোয়ার-ভাটার সাথেই যেন জেলেদের এক নিবিড় সম্পর্ক। পেটের তাগিদে নৌকা কিংবা ট্রলার নিয়ে ছোটেন গভীর থেকে গভীর সমুদ্রে। ঘরে ফিরে আসার মনোবাসনা নিয়ে সাগরে গেলেও অনেকেরই আর ফেরা হয় না পরিবার পরিজনের কাছে। দেখা হয় না প্রিয় সন্তান, স্ত্রী কিংবা বাবা-মায়ের মুখ। সাগরের এই বিশাল ঢেউয়ের শব্দে চাপা পড়ে যায় তাদের কান্না। প্রিয়জন হারানোর শোক ভুলে নিজেরাই এ পেশা বেছে নেয় অভাবের তাড়নায়। পেশার পরিবর্তন হয় না। ভাগ্যও বদলায় না তাদের। অথচ জীবন হারানোর মতো এমন ঝুঁকি নিয়েই বেঁচে আছে এই উপকূলের হাজার হাজার জেলে।

আরও পড়ুনঃ বাঁশখালীতে বাস-সিএনজির মুখোমুখি সংর্ঘর্ষে আহত ৫

উপকূলের জেলে পাড়ার সংগ্রামী মানুষ গুলো নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জিবনের ঝুঁকি নিয়ে মৎস্য আহরনে সাগরে পাড়ি দেয় প্রতিনিয়ত। সাগরে প্রাকৃতিক দূর্যোগ মহসিন, আইলা কিংবা মোরা'র মতো প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবেলা করতে গিয়ে কখনও তাদের স্বপ্ন গুলো সাগরে ভাসমান লাশ হয়ে ফিরে আসে। এখানেই শেষ নয়, জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়ে অনেক সময় লাশ হয়ে ফেরা চলে বিবর্ণ চেহারায়। স্বজনদের অনেকেই আজোও লাশের সন্ধান পায়নি। 

স্বজন হারা জেলে পল্লীর পরিবার গুলোর কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে যায়। নিদারুন কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয় পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তিকে হারিয়ে। ক্ষুধা দারিদ্র্যের কষাঘাতে দূর্বিসহ জিবনযাপন করছে জেলে পল্লীর স্বজন হারা পরিবার গুলো।


উপকূলের ঐতিহাসিক ট্রাজেডি: আজ ২৬ মার্চ ঐতিহাসিক ৩১ জেলে হত্যা দিবস। ২০১৩’র ২৪ ও ২৫ মার্চ বাঁশখালীর শেখেরখীল থেকে তিনটি মাছ ধরার ট্রলার সাগরে ডাকাতের কবলে পড়ে।


ডাকাতেরা দু’টি ট্রলার থেকে মাঝি-মাল্লাদের ধরে রশি বেঁধে সাগরে ফেলে দেয়। পরে সাগর থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত জলদস্যু ওয়াসিম তার জবানবন্দিতে বাইশ্যা ডাকাতের নেতৃত্বে ৫০-৬০ জন ডাকাত তিনটি নৌকাযোগে সমুদ্রে যাওয়ার কথা স্বীকারোক্তি দেন।

এসময় তারা শেখেরখীলের ট্রলার তিনটিকে লক্ষ্য করে অনবরত গুলি করে। পরে ট্রলারগুলো থামলে ডাকাতেরা সেখানে হানা দেয়। এসময় মাঝি-মাল্লাদের কয়েকজন জলদস্যুদের চিনে ফেলে, যার ফলে তাদেরকে বেঁধে সাগরে ফেলে দেয়া হয় নিশ্চিৎ মৃত্যুর কোলে। কয়েকজন মাঝি মাল্লা পানিতে ঝাঁপ দিয়ে রক্ষা পান। বঙ্গোপসাগরে জেলে হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতায় এর পূর্বে ২০১১ সালের মার্চে ১২ জন এবং নভেম্বর ১৪ জন জেলেকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। এরপর ২০১৭ সালে আবারো ১০ নভেম্বর ২ ফিশিং বোটসহ ১৫ মাঝিমাল্লাকে অপহরণ করে জলদস্যুরা। পরে মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। তারপরেও জীবনের তাগিদে থেমে নেই জেলেদের মৎস্য আহরণ ও শুঁটকি দেশে-বিদেশে রপ্তানির কাজ।


বাঁশখালী উপজেলার শেখেরখীল গুইল্যাখালী এলাকায় ৩১ জেলে হত্যার স্বজনহারা আবু তাহের, আলমগীর হোসেন, আবু ছিদ্দিক, আব্দু ছত্তার, বদি আলমের সাথে কথা হয়। তারা জানান, আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাই। আবার ফিরে আসব কিনা তাও জানিনা। জীবন বাজি রেখে সাগরে মাছ ধরি। ঝড়, বন্যা, জলদস্যু সব উপেক্ষা করে পরিবারের ভরন পোষন জোগাড় করতে সাগরে মাছ ধরতে যাই। বাড়ীতে ছেলে-মেয়েরা চিন্তায় থকেন। কখন মাছ ধরে বাড়ী ফিরে আসব। 


আলমগীর হোসেন জানান, আমার বড় ভাই জাহাঙ্গীর মাঝি ও আমার ভাইয়ের ছেলে সেদিন মাছ ধরতে যায় সাগরে। আমার ভাইয়ের সাথে ঘটনার দিন ভোর ৪টায় মুঠোফোনে কথা বলে জানতে পারি, মহেশখালীর জাহাজহাড়ী এলাকায় তারা জলদস্যুদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন। 


তিনি সর্বশেষ ডাকাত দলের অনেকের নাম বলেছিল আমাকে। হঠাৎ তার ফোনটি বন্ধ হলে ধরে নিয়েছিলাম তারা আর বেঁচে নেই। ২৫ মার্চ তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। বাঁশখালী জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল ৩১ জেলের নির্মম মৃত্যুর খবরে। নিহতের স্বজনেরা ডুকরে কেঁদে কেঁদে বলেন, আমাদের পরিবার এখন নিঃস্ব। বাবা হারা ছেলে, সন্তান হারা মা, ভাই হারা বোন সকলেই নির্মম হত্যাকান্ডের ৪টি বছর কেটে গেলেও আজো সঠিক বিচার পায়নি বলে জানান। মৎস্য আহরণ করতে গিয়ে জলদস্যুর কবলে পড়ে আর কতো জিবন গেলে সরকার তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিবে? বঙ্গোপসাগরে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতা কামনা করেছেন ভুক্তাভোগী জেলেরা।
 -

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top