পুঁজির অভাবে বাঁশখালীতে হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প

S M Ashraful Azom

পুঁজির অভাবে বাঁশখালীতে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ সংস্কৃতির শত বছরের ঐতিহ্যের মৃৎশিল্প


মাটির তৈরি শিল্পকর্মে পিছিয়ে নেই রুদ্র পাড়ার মেয়েরাও।
মাটির তৈরি শিল্পকর্মে পিছিয়ে নেই রুদ্র পাড়ার মেয়েরাও।

শিব্বির আহমদ রানা, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি: দেশীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে বাঙ্গালী জাতির শত শত বছরের ঐতিহ্য মৃৎশিল্প। সভ্যতার উৎকর্ষতা ও দিন দিন আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ মৃৎশিল্প। 

বর্তমানে বাজারে প্লাস্টিক সামগ্রীর বিভিন্ন ব্যবহারিক জিনিসপত্রের ভীড়ে বিলুপ্ত হচ্ছে দেশের মৃৎশিল্প। সেই সাথে প্রায় হারিয়ে গেছে মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজানো গ্রামীণ সংস্কৃতির নানা উপকরণ ও গৃহস্থালী নানান প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান। একসময় এদেশীয় সংস্কৃতিতে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের যথেষ্ট ব্যবহার ও কদর ছিলো। 

গ্রামীণ মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় গৃহস্তলির ব্যবহার্য জিনিসপত্রের চাহিদা মেটাতো এই মৃৎশিল্প। সহজলভ্য এই শিল্প আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। পূঁজির অভাবে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার মৃৎশিল্প। 

এক সময় এই উপজেলা মৃৎশিল্পের জন্য সুপ্রসিদ্ধ ছিল। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখানে এসে মাটির তৈরি জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেত। 

এমন এক সময় ছিল যখন, বাংলার ঘরে ঘরে মাটির তৈরির হাড়ি পাতিল, কলসি, থালা, বাটি, ফুলের টব, ফুলদানি, ব্যাংক, খাবার টেবিল, টালি, টাইলস, খেলনা, সৌখিন সামগ্রীসহ নানা জিনিসপত্রের ব্যবহার হত।

মাটির তৈরি হাড়ি পাতিল বিক্রির অপেক্ষায় কালীপুরের বিশ্বনাথ রুদ্র
মাটির তৈরি হাড়ি পাতিল বিক্রির অপেক্ষায় কালীপুরের বিশ্বনাথ রুদ্র


মৃৎশিল্পের বিভিন্ন উপাদানে গ্রামীণ বাংলার মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের রোমাঞ্চকর অনুভূতি, প্রেম-বিরহের নানা দৃশ্যপট, মনোমুগ্ধকর ছবি নরম হাতের স্পর্শে ফুটিয়ে তুলতেন শিল্পীরা। 

মৃৎশিল্পীরা এই শিল্পের উপর ভিত্তি করে একসময় শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত গড়ে তোলে। তৎকালীন সময়ে দেশের অর্থনীতিক বাজার চাঙ্গা রাখতে মৃৎশিল্পের কোন বিকল্পই ছিলনা। 

তবে বর্তমান দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিক, স্টিল, ম্যালামাইন, চিনামাটি, সিলভারসহ বিভিন্ন ধরনের ধাতব পদার্থের তৈরি হাড়ি-পতিল, খেলনা, সৌখিন জিনিসপত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বিলুপ্তির মুখে প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। 

এ পেশায় জড়িতরা ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও পর্যাপ্ত পূঁজির অভাবে অনেক শিল্পী বাপ-দাদার রেখে যাওয়া এই শিল্পকে ছেড়ে ভিন্ন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার অনেকে পেশার বাইরে কোন কাজ করতে না পেরে এখনো মৃৎশিল্পে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে। অভাব অনটনের সংসারের ঘানি টানতে হচ্ছে কোন রকমে।

লেখকের অন্য লেখা>মা দিবসেই নয়, মাকে ভালোবাসুন প্রতিদিন!

এক সময় পহেলা বৈশাখী মেলাসহ বছরের অন্যান্য সময়ে অনুষ্ঠিত মেলা পূজা-পার্বনে মাটির তৈরি মনোমুগ্ধকর খেলনা, সৌখিন জিনিসপত্র তৈরিতে বাঁশখালীর বিভিন্ন মেলায় এবং পাড়ায় পাড়ায় মহাধুম পড়ে গেলেও বর্তমানে তা শুধুই স্বপ্ন। 

সভ্যতার চরম উৎকর্ষতায় হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্যের বণার্ঢ্য সংস্কৃতির মৃৎশিল্প। জানা গেছে, বাঁশখালীতে মৃৎশিল্প তৈরীকারক পরিবারগুলোর মধ্যে চলছে অভাব-অনটন। কারণ তাদের তৈরি পণ্য এখন বাজারে চলছেনা বলে বদলে যাচ্ছে কুমারপাড়ার জীবনের চিত্র। 

চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার পূর্ব কালীপুর রুদ্র পাড়া। একসময় গ্রামে এ পেশার সাথে জড়িত ছিল প্রায় অর্ধশত পরিবার। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে মৃৎশিল্প প্রস্তুতকারী পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে মেলায় অংশ গ্রহণের জন্য তৈরী করছে ছোট ছোট পুতুল ও মাটির খেলনা। আবার অর্ডারের পন্যও তারা তৈরি করে। 

পরিবারের নারী সদস্যরাও পুরুষের পাশাপাশি সহযোগী হয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। পূর্বে মৃৎ শিল্পের খ্যাতি ছিল কিন্তু আজকাল অ্যালুমিনিয়াম, চীনা মাটি, মেলামাইন এবং বিশেষ করে সিলভারে রান্নার হাড়ি কড়াই প্রচুর উৎপাদন ও ব্যবহারের ফলে মৃৎশিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। কথিত আছে মৃৎশিল্প প্রায় দুই থেকে আড়াই শত বছর পূর্ব থেকে চলে আসছে। 

জানা যায় অতীতে এমন দিন ছিল যখন গ্রামের মানুষ এই মাটির হাঁড়ি কড়া, সরা,বাসন, মালসা ইত্যাদি দৈনন্দিন ব্যবহারের সমস্ত উপকরণ মাটির ব্যবহার করত কিন্তু আজ বদলে যাওয়া পৃথিবীতে প্রায় সবই নতুন রূপ। নতুন সাজে আবার নতুন ভাবে মানুষের কাছে ফিরে এসেছে। আজ শুধু গ্রাম বাংলার নয় শহরের শিক্ষিত সমাজ ও মাটির জিনিস ব্যবহার করে। 

অাধুনিক মানের হোটেল গুলোতে এখন বিরিয়ানী খাওয়ানোর জন্য মাটির তৈরি বাসন ব্যবহার করে। তবে তা বিচিত্ররূপে। এখন মানুষের রুচি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিত্য নতুন রূপ দিয়ে মৃৎ শিল্পকে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করছে।

হাড়ি-পাতিল তৈরির প্রস্তুতি চলছে তাদের তৈরি চুলায়
হাড়ি-পাতিল তৈরির প্রস্তুতি চলছে তাদের তৈরি চুলায়

বাঁশখালীতে কালীপুর রুদ্র পাড়া, কুমোর পাড়া, বাণীগ্রামের সাধনপুর, আনন্দ বাজার, উত্তর চাম্বল, দক্ষিণ চাম্বল এলাকায় এখনো মৃৎশিল্পের তৈরি দৃষ্টি নন্দন মাটির সামগ্রী কলসি, হাঁড়ি, পাতিল, সরা, মটকা, দৈ পাতিল, মুচি ঘট, মুচি বাতি, মিষ্টির পাতিল, রসের হাঁড়ি, ফুলের টব, চাড়ার টব, জলকান্দা, মাটির ব্যাংক, ঘটি, খোঁড়া, বাটি, জালের চাকা, প্রতিমা,বাসন-কোসন, ব্যবহারিক জিনিসপত্র ও খেলনা সামগ্রী ইত্যাদি পাওয়া যায়। 

মাটির তৈরি শিল্পকর্মের মধ্যে প্রায় ৯০ ধরনের পন্য তৈরি হয়। কালীপুর রৌদ্র পাড়ার মৃৎশিল্প পণ্যের বিক্রেতা বিশ্বনাথ রৌদ্র জানান, আমাদের বাপ দাদারা দীর্ঘ ৭০-৮০ বছর পূর্ব থেকেই মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। 

আমরাও পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যকে ধরে আছি। বর্তমানে আমাদের এলাকায় আমার ভাই মন্টু রুদ্র, হরিভক্ত, প্রনবিন্দ রুদ্রসহ ৭-৮টি পরিবারে মাটির তৈরি শিল্পকর্ম তৈরি হয়। তিনি জানান, মৃৎশিল্পের প্রধান উপকরণ এটেঁল মাটি এখানে খুব সহজলভ্য নয়। 

অনেক দূর থেকে পাহাড়ী অঞ্চলে ৬০ থেকে ৭০ ফুট গভীরে গিয়ে মাটি সংগ্রহ করতে হয়। তবে আমরা আগের মতো আর ব্যাপকভাবে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বানাতে সক্ষম নই। যা তৈরি হয় তা পাইকারী বিক্রি করে দিই। আমাদের উৎপাদিত পন্যের ক্রেতা আনোয়ারার এক ব্যবসায়ী ইউনুছ এসে নিয়ে যায়। বাঁশখালীর তৈরি শিল্পকর্মের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। 

প্রনবিন্দ রুদ্র জানান, অভাবের টানাপোড়নে কোন রকম সংসার চালাই। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শ্রমিকের খরচ সহ যাবতীয় খরচ নির্বাহ করি। অর্থাভাবে ব্যাপক উৎপাদনে যেতে পারিনা। কালীপুর রুদ্র পাড়ার ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সানন্দ রুদ্র জানান, পূর্বে এখানকার সকল পরিবারের লোকজন মৃৎ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। 

কিন্তু বর্তমানে সেখানে ৭-৮টি পরিবার কোন রকমে মৃৎ শিল্পের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছে। বর্তমানে মৃৎ শিল্পের বাজার খুবই খারাপ। কোন রকমে খেয়ে পড়ে চলে। শিল্পী না বাঁচলে শিল্প বাঁচে না উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, সরকার এই শিল্পের জন্য আলাদা ব্যাংক ঋণ, সরকারি বেসরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করলে মৃৎ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। 

তা না হলে অচিরেই বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যাবে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।





#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top