সময়ের সংলাপ: বর্তমান ছাত্ররাজনীতি বনাম বাংলাদেশ! |
বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল আছে। দলের কিছু আলাদা নিয়মতন্ত্র বা সংবিধান আছে। কিন্তু তাদের ফর্মূলায় ছাত্র রাজনিতীকে নিয়ে বর্তমানে যা দেখি তা খুবই অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়।
প্রথমে জেনে নিই ছাত্র কাকে বলে। সহজ কথায়, যে বা যারা বিদ্যা শিক্ষা অর্জনের জন্য জিবনের নির্দ্দিষ্ট কিছু সময় স্কুল-মাদরাসা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয় করেছেন তারাই ছাত্র। আর ছাত্র জিবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটা হচ্ছে পড়ালেখা করা, জ্ঞান চর্চা করা, সর্বাবস্থায় আদর্শ একজন নাগরিক হওয়ার মতো বিশেষ কিছু গুনে গুণান্বিত হয়ে গড়ে উঠা।
অামি ছাত্রদের রাজনীতি করার বিপক্ষে নয়। তবে অপরিপক্ব হয়ে কেনো তারা রাজনিতীতে জড়িয়ে পড়ে? অাবার কেন পড়ালেখা ছাড়া ছাত্র দাবী করে? কেন তারা ছাত্রত্বকে বিকিয়ে দেয়? আজকাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে যে চিত্রটা দেখি তা বড্ড অপ্রীতিকর! শিক্ষাপ্রতিষ্টান গুলোতে ছাত্রের মাঝে অ-ছাত্রে ভরে গেছে ।
আরও পড়ুন>>শিক্ষা ব্যবস্থায় আর কতো আবোল তাবোল পড়বে আমাদের সোনামনিরা!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন সন্ত্রাসের রাজত্ব। জ্ঞানের চর্চা এখন হয়না, তবে চলে অস্ত্রের ঝনঝনানি। ত্রাস আর ত্রাস সৃষ্টি করা যেনো অ-ছাত্রের নিত্য খেলা। জাতী গড়ার কারিগড় ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কথিত ছাত্রনেতার হাতে লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা নিত্য।
যা ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যকে তুচ্ছ করে তোলে। তখন মনে হয় এ জাতির জন্য শিক্ষা বিষয়টি তেমন শিরোধার্য নয়। মা-বাবার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের সারথি হয়ে ফিরে না এসে এরা ফিরে আসে লাশ হয়ে নতুবা সন্ত্রাস হয়ে। এসবের পিছনে যে টনিকটা কাজ করে তার নাম কালো রাজনীতির চর্চা।
দেশের কল্যাণে ছাত্রের ভূমিকা অপরিসীম। এদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই তো দেশের স্বাধিনতা এসেছে। তাঁদের ছিলো উচ্চমানের নৈতিকতা। তাঁরা শিক্ষাকে লালন করেছে সর্বাগ্রে। তাঁদের সময়ে রামদা, চাপাতি, অস্ত্র, হকিস্টিক, বোমা, মদের বোতল, ইয়াবার মতো মরণ নেশায় লিপ্ত থাকার মতো কেউ ছিলোনা।
কারণ তারা প্রকৃত ছাত্র। বাংলাদেশে নীচক হীনচেতার রাজনিতী আমাদের বাসযোগ্য পৃথিবীকে অস্বস্তিকর করে তুলেছে। বইয়ের বদলে হাতে অস্ত্র নিতে দেরি নেই, কলমের পরিবর্তে রামদাই এখন তাদের সহজলভ্য বস্তু।
আজকাল সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিধ্বংসিত। প্যান্ট পরতে পারলে, জামাটি প্যান্টে ইন করতে পারলেই তারা হয়ে যায় ছাত্র। এসব ছাত্রের পিছনের ইতিহাস- কেউ পান বিক্রেতা, জুতা সেলাইকারী, কেউবা কারো কেনা গাঁধা! সিএনজি চালক থেকে শুরু করে রিকশার ড্রাইভারকে যখন বলতে শুনি আমি অমুক দলের ছাত্রনেতা!
এ লজ্জা কাদের? এদের থেকে স্বাধীনতাকামী রফিক, শফিক, সালাম, জাব্বারের মতো ছাত্রনেতার অাবির্ভাব হবেনা। এদের থেকে জাতী ভালো কিছু আশা করতে পারবেনা। আমাদের ছাত্রসমাজ আজ প্রশ্নবিদ্ধ, অ-ছাত্রের সয়লাভে ভরেগেছে দেশীয় ছাত্ররাজনীতি।
আরও পড়ুন>>রিকশা আছে তবে সেকেলের অতীত নেই!
জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায় ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ছাত্র রাজনীতি বাংলার রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে৷ বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছাত্রদের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণে প্রণোদনা জোগায়৷
তবে জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সত্ত্বেও ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের উদ্যোগে নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি গঠিত হওয়ার আগে বাঙালি ছাত্রদের কোনো নিজস্ব সংগঠন ছিল না৷ ১৯৩০ সালের ১২ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম ছাত্রদের একটি সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শহীদুল্লাহ্কে একটি মুসলিম ছাত্র সমিতি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং ১৯৩২ সালে নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্র সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়৷ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিশেষত ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর ঘোষণার পর ওই বছর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ গঠন করা হয়৷
এ বছরই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন এবং তাতে নেতৃত্ব দেয় এ ছাত্রলীগ৷ ভাষাসমস্যার সমাধান হলেও ছাত্র আন্দোলন থামেনি৷ ১৯৫২ সালে পূর্ববাংলায় বাম রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে ওঠে ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন৷ ষাটের দশকের পরের সময়টা ছিল ছাত্র রাজনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়৷
ইতিহাস আমাদের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, ১৯৬৬ সালে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা কর্মসূচি এবং পরবর্তীকালে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হলে ছয়দফা সমর্থন ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ছাত্রদের মধ্যে এক নজিরহীন ঐক্য গড়ে ওঠে৷
এ লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালে সকল ছাত্রসংগঠন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং জাতীয় ও সমাজতান্ত্রিক ধারণাপুষ্ট ১১-দফা দাবিনামা উপস্থাপন করে৷ পরিষদ গোড়ার দিকে ১১-দফা দাবির জন্য আন্দোলন করলেও পরবর্তীকালে ছাত্রনেতারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ভাবতে শুরু করেন৷
আরও পড়ুন>>মা দিবসেই নয়, মাকে ভালোবাসুন প্রতিদিন!
১৯৭১ সালের মার্চে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে৷ এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্রসংগঠনগুলোর বীরত্বপূর্ণ অবদান সর্বজনস্বীকৃত ও যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে৷
তবে স্বাধীনতার পরই ছাত্র রাজনীতি গতি হারায়৷ ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগে আসে বিভক্তি৷ তৈরি হয় জাসদ ছাত্রলীগ৷ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় আসে৷ এরপর তো রাজনীতি চলেছে আরও উল্টোপথে৷ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গঠন করেন ছাত্রদল৷ সামরিক সরকার ধর্মীয় রাজনীতি শুরুর অনুমতি দিলে জামায়াত গড়ে তোলে তাদের ছাত্র সংগঠন শিবির৷
এরপরেই ক্যাম্পাসগুলোতে শুরু হয় শিবিরের সাথে অন্যদের সংঘর্ষ৷ আশির দশকটা সারা দেশের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষ চলতে থাকে৷ দিনের পর দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে৷ নৈরাজ্যের সাতকাহন বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে বর্তমান সময়ে।
আরও পড়ুন>>বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট নিয়ে কিছু কথা : আহমেদ রায়হান
আজ ছাত্ররাজনীতি তাদের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। যখনই রাজনতৈকি সরকারগুলো ক্ষমতায় আসে তখনই ছাত্রসংগঠনগুলো ক্রমেই তাদের উপাঙ্গ হয়ে ওঠে৷ রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের স্বার্থে ছাত্রনেতাদের ব্যবহার শুরু করে৷ ফলে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, সীট দখলের রাজনীতি তো আছেই; সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের বাণিজ্য।
ভর্তি, নির্মাণ, উপকরণ সরবরাহ ইত্যাদি শুরু হয় ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে। কিন্তু ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতারা ক্যাম্পাসে যা ইচ্ছে তা করলেও প্রশাসন সেটি উপেক্ষা করতে শুরু করে কিংবা প্রশ্রয় দেয়৷ একটু পেছনে ফিরলে দেখা যাবে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যাঁরা ছাত্ররাজনীতি করতেন, তাঁরা ছিলেন ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রী৷ নিয়মিত ক্লাস করে, পরীক্ষা দিয়ে, নানা বিষয়ের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে তাঁরা নিজেদের রাজনীতিসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ডে জড়াতেন৷
কিন্তু এখনকার ছাত্রনেতাদের পড়াশোনার সময় নেই৷ মূল সংগঠনের স্লোগান দেওয়ার মধ্যেও তারা চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি বা অর্থ আয়ের পথ খোঁজে৷ ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলো আবাসিক হলগুলোতে সীট বাণিজ্য করে৷ জোর করে শিক্ষার্থীদের মিছিল মিটিংয়ে নেওয়া হয়৷ কেউ না গেলেই নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন৷
আরও পড়ুন>>বাঁশখালী উপকূলে জেলে পাড়ার কান্না আজোও থামেনি
আমি অন্তত শকুন শুকুনকে, কাক কাককে কামড়াতে দেখিনি! যদিওবা তা ঘটে অন্যায় বলতে পারিনা, কারণ তারা পশু। তাদের বিবেক বলতে মুল্যবান অলংকারটুকু নাই বলে তারা পশু। কিন্তু মানুষ মানুষকে কামড়ানোর দৃশ্যটা দেখলে বড় হাফিয়ে উঠি। ছাত্রই ছাত্রের মানসম্মানের টানাটানি করে। এক ছাত্র আরেক ছাত্রের প্যান্ট খোলার মতো অপ্রীতিকর কাজ করতে কিঞ্চিৎমাত্র দ্বীধা করেনা! এ লজ্জা রিকশার ড্রাইভারের নয়, এ লজ্জা সিএনজি চালকের নয়! এ লজ্জা কথিত ছাত্রসমাজের।
দেশের রাজনিতীতে ছাত্রের যায়গা গুলো অ-ছাত্রের দখলে। তখন জাতী লাঞ্চিত ত হবেই। আজ শিক্ষাপ্রতিষ্টান অস্ত্রের মহড়ায় অভ্যস্ত। গাজা, মদ, ইয়াবার মতো নেশায় আসক্ত। প্রশ্ন হচ্ছে -এদের হাতে দেশ, জাতী কতটুকু নিরাপদ? এরা দেশকে কি উপহার দেবে? এদের থেকে জাতী কী শিক্ষাটা পাবে? বর্তমান ছাত্র রাজনীতির আরেকটা মূল সমস্যা, যারা নেতা তাদের হয় ছাত্রত্ব নেই, কিংবা থাকলেও তারা নিয়মিত ছাত্র নন৷
অথচ এমন আইন করা উচিত যাতে এসএসি পরীক্ষার জন্য কেউ নিবন্ধন করার ১০ বছর পর আর কেউ ছাত্র রাজনীতি করতে পারবে না৷ তাতে দেখা যাবে ২৫ থেকে ২৭ বছর বয়সেই একজনের ছাত্র রাজনীতি শেষ হবে৷
কিছুদিন আগে আমার একটা অনলাইন প্রতিবেদন "চট্টগ্রাম দক্ষিণজেলা ছাত্রদলের কমিটিতে বিবাহিত লোক ছাত্রনেতা" শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুন>>চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রদল কমিটি অছাত্র দিয়ে গঠন: প্রতিবাদে বাঁশখালী ছাত্রদল
এর প্রতিবাদে উপজেলা ছাত্রদল বিক্ষোভ করে অতচ ঐ বিক্ষোভে ছাত্রনেতার মিছিলে বৃদ্ধাও! বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি যেন একটি নাম। বাস্তব দর্শনে তা ব্যতিক্রম। আমি এখানে ছাত্রদলকে ইন্ডকেট করছিনা। প্রায়ই সবকটি দলে ছাত্রের নামে অ-ছাত্রের মিশ্রণ লক্ষণীয়। রিকশা চালক, ভ্যানচালক সহ অনেকেই আজ দাবী করে তারা ছাত্রনেতা।
এদের শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করলে পাওয়া যাবে তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ালেখাটাও শেষ করেনি। তাই দেশে ছাত্ররাজনীতি গতি হারাচ্ছে। সরে যাচ্ছে নৈতিক আদর্শের পথ থেকে। আজ অতলেই হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ছাত্ররাজনীতির অতীত ঐতিহ্য।
শিব্বির আহমদ রানা
লেখক ও সাংবাদিক