চলনবিলের আয়তন ও বিলুপ্তির পথে মৎস্য সম্পদ

S M Ashraful Azom
0
চলনবিলের আয়তন ও বিলুপ্তির পথে মৎস্য সম্পদ
আশরাফুল ইসলাম রনি,তাড়াশ প্রতিনিধি : ১৯৬৭ সালে চলনবিলের ইতিকথা বইতে এম এ হামিদ লিখেছেন, ১৯২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫শ’ বর্গমাইলের উপরে। ১৯০৯ ইং সালে চলনবিল জরিপ কমিটির রিপোর্টে উল্লেখিত তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল।

এরমধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকা সারাবছর পানি জমে থাকতো। ওই রিপোর্টে বলা হয়, চলনবিল তার জলশ্রোতধারা ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। বর্তমানে বর্ষা মৌসুমে এর আয়তন দাঁড়ায় মাত্র ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার।

শুষ্ক মৌসুমে মূল বিলটির আয়তন দাঁড়ায় ১৫.৯ থেকে ৩১ কি. মি.। এছাড়া বিলের গভীরতা ১.৫৩ মিটার থেকে ১.৮৩ মিটার। প্রতিবছর চলনবিলের আয়তন হ্রাস পাচ্ছে। বাড়ছে ফসলী জমি। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র। ১৯০৯ইং সালের পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯১৪ সালে বৃটিশ আমলে সিরাজগঞ্জ হতে পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের ফলে বিলের অপেক্ষাকৃত উঁচু উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে ভাটা পড়ে।

এরপর থেকেই  চলনবিলের আয়তন সংকীর্ণ হতে শুরু করে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

এছাড়া পদ্মার পলি জমে গত কয়েক দশকে বিলের দক্ষিণাংশের প্রায় ২১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা শুকিয়ে গেছে। চলতি দশকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়ক নির্মাণের পর পানি প্রবাহে আরও বেশি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ফলে বিলের দেশীয় প্রজাতির প্রায় ৫০ প্রকার মাছের অধিকাংশরই বিলুপ্তি ঘটেছে।

বিলুপ্ত প্রায় এসব মাছের মধ্যে রয়েছে কই, শিং, মাগুর, কাঁকিলা, শোল, বোয়াল, চিতল, মোয়া, হিজল, তমাল, জারুল বাতাসি, টেংরা, গোলসা, নন্দই, পুটি, সরপুটি, খলিশা, চেলা, ডানকানা, টাকি, বাইটকা, বাউস, কালোবাউস, চ্যাকা, বাইম, বউমাছ, গোঁচৌ, গোরপুইয়া, কুচিয়া, কচ্ছপ,কাছিম ও কাঁকড়া ইত্যাদি। প্রবীনেরা  বলেন, মাছ আর পানি যেন ছিল সমান সমান।

এছাড়া বর্ষা মৌসুমে হাজার হাজার নারী পুরুষ শ্রমিক শুটকি উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু শুটকি সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় বর্তমানে এর উৎপাদনও কমে গেছে।

এ দিকে, কালের বিবর্তনে শত বছরের ঐতিহ্যধারী চলনবিল আজ মরা বিলে রূপান্তরিত হচ্ছে। মহাসড়ক নির্মাণ, অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ,কালভার্ট, স্লুইচগেট, ক্রসবাঁধ ও দখল-দুষণসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কারণে ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে এ বিল।

প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও নানা প্রতিকুল পরিবেশের কারণে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এর আয়তন। বিলের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর জেলার ১৬টি নদী করতোয়া, ইছামতি, গুমানী, গোমতী, আত্রাই, ভদ্রাবতী, গোহালা, বড়াল, নন্দকুজা, গাড়াদহ, কাকন-কানেশ্বরী, স্বরসতী, মুক্তাহার, গোহালা, ঝবঝবিয়া, ফুলজোড় নদী ছিল চলনবিলের প্রাণ, কিন্তু ধিরে ধিরে এসব নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে বিলুপ্তির পথে চলনবিলের দেশিও প্রজাতির মৎস্য সম্পদ। এক সময় বিলের মাছ দেশর চাহিদা মিটিয়েও ভারতে রপ্তানি করা হতো।

অন্যদিকে প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসীরা জাল দলিল তৈরী করে দখলে নিয়েছে কয়েক হাজার একর জমি। উপজেলা ভুমি অফিসের রেকর্ড থেকে জানা গেছে, চলনবিলের ১০টি উপজেলার আবাদযোগ্য বেশির ভাগ খাস জমি ও জলাশয় এখন প্রভাশালীদের দখলে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ,সলঙ্গা, উল্লাপাড়া, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, নাটোরের গুরুাসপুর, সিংড়া, বড়াইগ্রাম ও নওগাঁর আত্রাই নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল।

গঠনকালে চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১ হাজার ৮বর্গ কি: মি:। এই বিলে রয়েছে ৩৯টি উপ বিল, ৪ হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ছোট-বড় ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি খাল। ২২টি খালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-নিমাইচড়া খাল, নবীর হাজির জোলা, বেশানীর খাল, হক সাহেবের খাল, উলিপুর খাল, গুমানী খাল, কুমারভাঙ্গা খাল, গাড়াবাড়ি খাল, জানিগাছার জোলা, কিনু সরকারের ধর ও সাত্তার সাহেবের খাল।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানা যায়, গত ২৮ বছরে চলনবিলের গভীরতা কমেছে ৩থেকে ৫ ফুট। অন্যদিকে চলনবিলের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত নদী ও খালগুলো ভরাট এবং নদীর উৎসমুখ বন্ধ করে দেয়ায় বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায়  বিস্তৃত চলনবিলের বক্ষে এখন চাষ হচ্ছে ধান, গম, ভুট্টা, সরিষাসহ নানা জাতের সবজি, মশলা, রসুন পিঁয়াজ। বিলে বর্তমানে ফসলি জমির পরিমাণ ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৩৫ হেক্টর। এ সকল জমিতে চাষের জন্য অনেক গভীরতা করে শ্যালো মেশিন বসিয়েই ঠিকমতো পানি পাওয়া যাচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। আবার এতোদিন যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত তারাও এখন পেশা পরিবর্তন করে ফসলের মাঠে কাজ করছে। বাংলাদেশ সরকারের চলনবিল মৎস্য প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী- ১৯৮২ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে এক সমীক্ষায় দেখা যায় ১৯৮২ সালে মোট ১৭৭০৬১ জেলে এসব নদ-নদী ও খাল জলাশয়ে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। পর্যায়ক্রমে কমতে কমতে ২০০৬ সালে এর সংখ্যা ৭৫ হাজারে দাঁড়ায়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, “চলনবিলকে রক্ষা করতে হলে যমুনা ও পদ্মা নদীসহ বিলের প্রধান প্রধান সবনদী ও খাল ড্রেজিংয়ের আওতায় এনে পানির প্রবাহ সৃষ্টি ও ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। নদী দখল বন্ধ ও বেদখল হওয়া জায়গা উদ্ধার করতে হবে। জনগনের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বিলের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সব ব্রিজ, কালভার্ট, ক্রসবাঁধ, স্লুইচগেট, অপসারণ করতে হবে। তাই ঐতিহ্যবাহী এই বিলের নদী-উপনদীগুলো রক্ষায় আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে ভবিষ্যতে এর অস্তিত্ব থাকবে না বলে বিশেষজ্ঞ মহল আশংকা প্রকাশ করেছেন।

এ ব্যাপারে তাড়াশ উপজেলা মৎস্য অফিসার মো. হাফিজুর রহমান জানান, বাংলাদেশের মিঠা পানির অন্যতম প্রধান উৎস চলনবিল। এটা একটি উম্মুক্ত জলাশয়। খাল ও নদীতে বিভিন্ন প্রজাতীর মাছ রয়েছে। এইটা প্রাগতৈহাসিককাল হতে অব্যতহ ছিল। যুগে যুগে মৎস্য ভান্ডারে পরিনত হয়েছিল। কিন্তু সাপ্রাতিক কিছু প্রভাবশালী লোকজন বিভিন্ন খাল ও নদী ভরাট করায় নদীগুলো আজ মরা নদীতে পরিনত হচ্ছে। বর্তমান সরকার খাল ও নদীগুলো আবারো খনন করার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। চলনবিল আবার আগের চিরচেনা যৌবন ফিরে পাবে বলে আশা করছি।


⇘সংবাদদাতা: আশরাফুল ইসলাম রনি
ট্যাগস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top