
সেবা ডেস্ক: বছর দুয়েক আগে এ পথেই গিয়েছিলাম। তখন এ সড়কে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্রোত ছিল। সেই স্রোত ঠেলে টেকনাফ যেতে চার ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে মানুষের সেই স্রোত দেখা না গেলেও আশপাশের পাহাড় ও সমতল এখন বস্তির নগরী। যেদিকে চোখ যায় শুধু ছোট ছোট ঘর। কোথাও বাঁশের খুঁটিতে পলিথিনের আচ্ছাদনে ঢাকা ঝুপড়ি ঘর, কোথাও ত্রিপলের খুপরি। আবার কোথাও টিনের ঘর। রাস্তার দুই পাশে যেন নতুন এক 'নগরী'। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই লেদা ক্যাম্পে। ক্যাম্পে গিয়ে বেশ পরিবর্তন চোখে পড়ল। অনেক কিছুই বদলে গেছে। যে পাহাড়ি পথে হাঁটুসমান কাদা ডিঙাতে হতো। সেই পাহাড়ের বুক চিরে, ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। যেখানে পা রাখা যেত না, সেখানে অবলীলায় চলছে মালবাহী গাড়ি, অটোরিকশা, ভ্যানসহ অন্যান্য যানবাহন। পাহাড়ি নালার ওপর এখন কংক্রিটের ব্রিজও হয়েছে। ক্যাম্পে প্রবেশ করতে করতে বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা।
পড়ন্ত বিকেলে রোহিঙ্গা শিবিরে কিছুটা শান্ত পরিবেশ নেমে আসে। তবে পাড়াগাঁয়ের মতোই এখানে গড়ে ওঠা দোকানগুলো বেশ সরগরম। দোকানে চলছে নানা রকম আলোচনা। তবে সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছে নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার বিষয়। তাদের আলোচনায় কান পাতলেই উৎকণ্ঠার আভাস পাওয়া যায়। যাদের নিয়ে এত সংবাদ, সেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী গণমাধ্যমে প্রচারিত নিজেদের সংবাদ খুব কমই পায়। শিবিরজুড়ে গুজবই যেন সংবাদ। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো নিয়ে চলছে নানা রকম ধূম্রজালও। কেউ কেউ রোহিঙ্গাদের উস্কে দিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির ষড়যন্ত্র করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত শনিবার রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে প্রত্যাবাসনবিরোধী প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় সব ক্যাম্পেই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। দফায় দফায় চলছে বৈঠক। ক্যাম্পের দোকানপাট থেকে শুরু করে সব মোড়ে রোহিঙ্গাদের জটলা। তাদের নানা রকম আলোচনা করতে দেখা গেছে। নিজ দেশ নিয়ে তাদের মধ্যে চরম অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার তিন হাজার ৫৪০ জনকে মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার খবরকে তারা ওই দেশের সরকারের ছলচাতুরীর অংশ হিসেবে দেখছেন।
আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গা নেতারা বলেছেন, এটি মিয়ানমারের নতুন একটি চাল। যেহেতু জাতিসংঘের আগামী অধিবেশন আসন্ন। তাই তারা বিশ্ববাসীকে দেখাতে চাইছে- তারা তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করতে আগ্রহী। এর আগে গত বছরের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কাজ শুরু করার দিনক্ষণ ধার্য ছিল। শেষ মুহূর্তে রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব ছাড়া নিজ দেশে ফিরে যাবে না- ঘোষণা দিলে প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়টি ভণ্ডুল হয়ে যায়। বর্তমানেও অনুরূপ পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের প্রধান দাবি- নাগরিকত্ব না পেলে তারা নিজ দেশে ফেরত যাবে না। পাশাপাশি রয়েছে সুনির্দিষ্ট আরও পাঁচটি দাবি। অথচ, এর কোনোটিই পূরণ হয়নি। তবে ফিরে যাওয়ার পর নাগরিকত্ব প্রদানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে; তাও শর্ত সাপেক্ষে। এ অবস্থায় লাখ লাখ রোহিঙ্গার মধ্য থেকে কেউ এখনও প্রকাশ্যে বলেনি- তারা নাগরিকত্ব ছাড়াই ফিরে যেতে আগ্রহী।
অপরদিকে, রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফিরে যেতে না পারে, এমন তৎপরতায় রয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন গ্রুপ। তারা প্রতিনিয়ত শিবিরে শিবিরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ। ইতিপূর্বে যাওয়ার আগ্রহ দেখানো কেউ কেউ খুনও হয়েছেন বলে জানা গেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সোমবার ভোরে প্রত্যাবাসনকে ঘিরে টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরের একটি মসজিদে ১৪০ জন রোহিঙ্গা নেতা গোপন বৈঠক করেন। বৈঠকে জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চাইলে তারা সেটি কঠোরভাবে প্রতিহত করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। এমনকি প্রত্যাবাসনের দিন রোহিঙ্গা শিশু-নারীদের ব্যবহার করে একটি বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিকল্পনাও রয়েছে। এমন জটিল পরিস্থিতিতে প্রত্যাবাসনকে ঘিরে রোহিঙ্গা শিবিরে সরকার ও বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) লোকজনের দফায় দফায় বৈঠক চলছে। বৈঠকে প্রত্যাবাসন নিয়ে গুজব ও অপপ্রচার রোধে রোহিঙ্গা চেয়ারম্যান, টিম লিডার, প্রধান মাঝি, শিক্ষক, ইমাম, রোহিঙ্গা নারীসহ বিভিন্ন এনজিওর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে মিয়ানমারে পাঠানো হবে না বলে জানানো হয়। গতকাল সকাল থেকে টেকনাফের জাদিমুরা শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরের নারী-পুরুষদের আলাদা বৈঠক করতে দেখা গেছে। জোর করে কাউকে মিয়ানমারে পাঠানো হবে না বলে প্রচার চালানো হচ্ছে।
এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হলে সেদেশে কী পরিস্থিতি হবে, তা নিয়ে মিয়ানমারের (রাখাইন) ভাষায় লেখা লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। লিফলেটের ওপরে মিয়ানমার সরকারের মনোগ্রাম দেখা যায়। রোববার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টেকনাফের জাদিমুরা শালবন রোহিঙ্গা শিবিরে একটি গাড়িতে কিছু লোক এসব লিফলেট বিতরণ করেছিল। নয়াপাড়া ও লেদা রোহিঙ্গা শিবিরেও লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। লিফলেটে বিভিন্ন ছবি অঙ্কনের মাধ্যমে যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে গেছে, তাদের জীবনযাপনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
লিফলেট বিতরণ নিয়ে টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা বদরুল ইসলাম বলেন, মূলত ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ডকে (এনভিসি) গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেখানে। যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যাবে, তাদের প্রথমে এনভিসি কার্ড দেওয়া হবে। তারপর এই কার্ড নিয়ে নাগরিকত্বের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। এই কার্ডের মেয়াদ থাকবে দুই বছর। এই সময়ের মধ্যে আবেদন করতে হবে।
এক টাউনশিপের লোকজন অন্য টাউনশিপে যেতে পারবে না বলে লিফলেটে উল্লেখ করা হয়েছে জানিয়ে এ রোহিঙ্গা নেতা বলেন, যারা সড়কপথে ঘুমধুম দিয়ে ফিরবে, তারা সেদেশের তম্ব্রু এবং যারা নদীপথে টেকনাফের কেরনতলী ঘাট দিয়ে ফিরে যাবে, তাদের গজবিল লম্বা হালি নামক এলাকায় এক-দুদিন থাকতে হবে। এর পর সেখান থেকে তাদের মংডু এলাকার আইডিপি ক্যাম্পে রাখা হবে দুই মাস। সেখান থেকে সরকার নির্ধারিত জায়গায় যেতে হবে তাদের। লিফলেটে আরও বলা হয়েছে, পেশায় যারা জেলে, তাদের মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ দেওয়া হবে। আর চাষিরা চাষাবাদ করার সুযোগ পাবে।
নাম না বলার শর্তে এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, শিবিরে কাজ করছে এমন একটি এনজিওর কর্মীরা গাড়িতে এসে এসব লিফলেট বিতরণ করছেন। এ নিয়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে নানা কানাঘুষা চলছে।
লিফলেট বিতরণ আর সচেতনতা যাই হোক- কোনো কিছুতেই রোহিঙ্গাদের অবিশ্বাস দূর করা যাচ্ছে না। সবকিছুকেই তারা এখন ষড়যন্ত্র মনে করছে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা রোহিঙ্গারা মনে করে, আগুনের কুণ্ডলীতে ফিরে যাওয়ার চেয়ে বাংলাদেশে 'বন্দিশিবিরে' থাকা অনেক ভালো।
টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া জসিম উদ্দিন বলেন, এর আগেও মিয়ানমার সরকার আমাদের সব ধরনের অধিকার প্রদান করবে বলে আশ্বস্ত করেছিল। সে কথা তারা রাখেনি। নতুন করে প্রত্যাবাসন শুরুর কথা বলা তাদের ছলচাতুরী ছাড়া কিছুই নয়। একই অভিমত পাওয়া গেল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিনের বক্তব্যে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি মিয়ানমারের গেম। দীর্ঘসূত্রতার কৌশলটা মিয়ানমার ভালোই শিখেছে। বিশ্বকে দেখাচ্ছে- আমরা তো বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করছি। তোমরা অধৈর্য হচ্ছ কেন? তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্বস্ত করার মতো কোনো পদক্ষেপ মিয়ানমার নিচ্ছে না। পুরো বিষয়টি একটি দ্বৈত চরিত্রের মতোই মনে হচ্ছে। একদিকে তারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে খেলছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ বারবার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কথা বললেও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে আশ্রয় শিবির নির্মাণসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। টেকনাফ ও উখিয়ায় থাকা রোহিঙ্গারা এখন সব ধরনের নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে। ফলে তারা এ সুবিধা ত্যাগ করে অনিশ্চিত জীবনে যেতে চাইবে না- এটাই স্বাভাবিক।
এতকিছুর মাঝেও তিন হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরত পাঠাতে প্রস্তুতি প্রায় শেষ। সংস্কার করা হয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফের প্রত্যাবাসন ঘাট। এ ছাড়া প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য শিবিরের কর্মকর্তার (সিআইসি) কার্যালয়ের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে কিছু ঘর। টেকনাফের নাফ নদের তীর ঘেঁষে সরকারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের অধীন কেরনতলী (নয়াপাড়া) প্রত্যাবাসন ঘাট। ঘাটটি চারদিকে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, টিনের তৈরি আধাপাকা সারি সারি ঘর। এক লাইনে ১১টি করে তিন লাইনে ৩৩টি কক্ষ। প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের ফেরতের আগে প্রথমে এখানে রাখা হবে। তাদের দেখভালে যুক্ত কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা চারটি ঘরও রয়েছে। ট্রলারযোগে প্রত্যাবাসনের জন্য নদীতে স্থাপিত হয়েছে লম্বা কাঠের জেটি। প্রত্যাবাসন কেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে আনসার ব্যাটালিয়নের একটি দল। ঘাটে কয়েকজন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে।
এ ছাড়া টেকনাফের নয়াপাড়া জাদিমুরা শালবন রোহিঙ্গা শিবিরে সিআইসি কার্যালয়ের পাশেও তড়িঘড়ি করে প্লাস্টিকের ছোট ছোট চারটি লম্বা ত্রিপল এবং বাঁশের ঘর বানানো হচ্ছে। এসব ঘরে প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কর্মকর্তারা আলোচনায় বসবেন বলে জানা গেছে।
টেকনাফের জাদিমুরা শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরের ইনচার্জ মোহাম্মদ খালেদ হোসেন বলেন, সরকার কাউকে মিয়ানমারে জোর করে পাঠাবে না বলে গতকাল তার শিবিরে বার্তা দেওয়া হয়। ফলে কারও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আজ সকাল থেকে প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎ নেওয়া হবে। মতামতের জন্য একটি করে ফরম দেওয়া হবে। ফরমে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান কি-না, তার জবাব দেবেন। কেউ ফিরতে না চাইলে, কেন যেতে চান না- মন্তব্যের ঘরে সে কথা লিখতে হবে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎ নেওয়ার সময় জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি, শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন।
-সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশে আপোষহীন

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।