সেবা ডেস্ক: সম্প্রতি “আমেরিকায় প্রবেশ করতে পারেননি বিনা ভোটের সরকারের প্রতিমন্ত্রী জোনাইদ আহমদ পলক। তার পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি ছিলো ওয়াশিংটন নিউইয়র্কে! কিন্তু মার্কিন সরকার তাকে ঢুকতে দেয়নি। চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কানাডা ঘুরে দেশে ফিরে গেছেন এ মহারাজ।” শীর্ষক একটি তথ্য সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
ভাইরাল কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে
পরবর্তীতে, গত ৩ জানুয়ারি ৬.২৪ মিনিটে তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ এবং আইডিতে স্ব-পরিবারে যুক্তরাষ্ট্র সফরের বেশকিছু ছবি ও তথ্য উল্লেখ করে পোস্ট করেন। প্রতিমন্ত্রীর পোস্ট ছাড়াও তার স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা তাদের যুক্তরাষ্ট্র সফরের আরো কিছু ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করেন।
তবে, তাদের প্রকাশিত ছবিগুলোকে পুরোনো দাবি করে অতি সম্প্রতি “সরকারের মন্ত্রী-এমপি-আমলারা এতোটাই দেউলিয়া যে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুরাতন ছবি পোস্ট দিয়ে জনগণকে বিশ্বাস করাতে চাচ্ছেন তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিষিদ্ধ নয়” শীর্ষক আরেকটি তথ্য পুনরায় সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হতে থাকে। অর্থাৎ, উক্ত পোস্টগুলো অনুযায়ী মূল দাবি হলো প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে না পেরে দেশে ফিরে এসে কোন এক সময়ের যুক্তরাষ্ট্র সফরের পুরোনো ছবি ফেসবুকে প্রচার করছে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর নিশ্চিত হওয়া যায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের গত ৩ জানুয়ারিতে ফেসবুকে প্রকাশিত ছবিগুলো পুরোনো নয় বরং ছবিগুলো গত মাসেই অর্থাৎ ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসেই তোলা হয়েছে। অর্থাৎ তার যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে না পারার বিষয়টি সম্পূর্ণ গুজব এবং প্রকৃতপক্ষে কানাডার টরেন্টো, যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ও ওয়াশিংটন সফর শেষে দুবাই হয়ে গত ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ফিরেছেন তিনি।
জুনাইদ আহমেদ পলক তার ফেসবুক পেজে গত ৩ জানুয়ারিতে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ধারণ করা মোট ১৭ টি ছবি প্রকাশ করেন। তার ফেসবুক পোস্টে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী তিনি গত ২৫ ডিসেম্বর টরেন্টোর ‘Toronto Pearson International Airport’ থেকে ‘AC 7510’ ফ্লাইটে করে বোস্টনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বোস্টনে ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর দিনে অবস্থান করে সেখান থেকে ‘Delta 5798’ ফ্লাইটে করে ওয়াশিংটনে যান তিনি।। বোস্টনে তিনি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল এবং ওয়াশিংটনে তিনি হোয়াইট হাউজ, লিংকন মেমোরিয়াল, আর্ট অ্যান্ড টেকনোলজি মিউজিয়াম, সায়েন্স মিউজিয়াম এবং ওয়াশিংটন হিস্ট্রি মিউজিয়াম পরিদর্শন করেন। পরবর্তীতে গত ১ জানুয়ারি রাত ১০ টায় বাংলাদেশে ফিরেন তিনি।
রিউমর স্ক্যানার টিম তার উল্লেখ করা দুইটি ফ্লাইটের (AC 7510 & Delta 5798) তথ্যই খুঁজে পেয়েছে। ফ্লাইটএয়ার এর তথ্য অনুযায়ী Air Canada (AC) 7510 ফ্লাইটটি গত ২৫ ডিসেম্বর টরেন্টো থেকে ইস্টার্ন টাইম বিকেল ৩.২২ মিনিটে যাত্রা করে বিকেল ৪.৫৬ মিনিটে বোস্টন পৌছায়।
পাশাপাশি, Delta 5798 ফ্লাইটটি গত ২৭ ডিসেম্বরে বোস্টন থেকে ইস্টার্ন টাইম সন্ধ্যা ৭.২২ (৩ মিনিট পূর্বে) মিনিটে যাত্রা করে রাত ৮.৫৯ (২৩ মিনিট পূর্বে) মিনিটে ওয়াশিংটন পৌছায়
জুনাইদ আহমেদ পলক তার ফেসবুক পোস্টে ডিরেক্টর অফ হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি সাউথ এশিয়া ইন্সটিটিউট এর প্রফেসর Tarun Khanna এবং এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর অফ হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি সাউথ এশিয়া ইন্সটিটিউট Hitesh Hathi এর নাম উল্লেখ করেছেন। এছাড়া সেখানে তিনি ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব শহীদুল ইসলাম এবং বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বর্তমানে বিশ্ব ব্যাংকে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি শফিউল আলম এর নাম উল্লেখ করেছেন।
রিউমর স্ক্যানার টিম তার প্রকাশিত ছবিগুলোর মধ্যে হিতেশ হাথি, রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলাম এবং সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব শফিউল আলমকে শনাক্ত করতে পেরেছে।
জনাব পলকের তার ছেলের সাথে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তোলা ছবিটি অনুসন্ধান করে দেখা যায় ছবিটি গত ডিসেম্বর মাসেই তোলা হয়েছে। মূলত, ছবিটিতে থাকা রাস্তার ডানপাশে একটি ক্ষণস্থায়ী কালো রঙ এর পর্দা জাতীয় কিছু লক্ষ করা যায় এবং এর পাশে ল্যাম্পপোস্ট এর ঠিক পেছনে থাকা একটি জরাজীর্ণ গাছ লক্ষ করা যায়। তবে ছবিটিতে বামপাশে থাকা গাছে কিছু সবুজ পাতা দেখা যায়।
পরবর্তীতে, হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থাৎ গত ডিসেম্বর মাসে ভ্রমণ করা একাধিক ব্যক্তির সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায় (পোস্টগুলো দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে) ।
সেসকল পোস্টগুলোতে সংযুক্ত ছবিতে একইভাবে রাস্তার ডানপাশে থাকা ক্ষণস্থায়ী কালো রঙ এর পর্দা জাতীয় একই বস্তু লক্ষ করা যায় এবং জরাজীর্ণ গাছ এবং বাম পাশে থাকা সবুজ পাতার গাছটিও একইভাবে লক্ষ করা যায়।
এরপর হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল ক্যাম্পাস থেকে বছরের বিভিন্ন সময়ে তোলা ছবিগুলো খুঁজে বের করি (পোস্টগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে) আমরা তবে সেসব ছবির সাথে ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত ছবির গাছগুলোর কোন মিল নেই।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বছরের অন্যান্য মাসে ধারণ করা ছবিগুলোতে রাস্তার ডানপাশে থাকা ক্ষণস্থায়ী কালো রঙ এর পর্দা জাতীয় বস্তুটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, ডিসেম্বর মাসে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে অন্যান্য ব্যক্তিদের তোলা ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথেও জুনায়েদ আহমেদ পলকের ছবির মিল রয়েছে।
ওয়াশিংটনে অবস্থিত লিংকন মেমোরিয়াল এর ছবিটিও যাচাই করে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। প্রতিমন্ত্রীর স্ব-পরিবারে লিংকন মেমোরিয়াল এর সামনে থেকে তোলা ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকা গাছগুলোর সাথে অন্যান্য ইন্টারনেট ইউজার কর্তৃক সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড এর হুবহু মিল রয়েছে (পোস্টগুলো দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে)। সাম্প্রতিক সময়ে এই গাছগুলো শুকিয়ে গেছে তবে বছরের অন্যান্য সময়ে এই গাছগুলো কিছুটা সতেজ থাকে।
তবে ছবিগুলো যে সাম্প্রতিক সময়ের এই দাবিটির স্বপক্ষে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হলো ওয়াশিংটনে অবস্থিত হোয়াইট হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে তোলা ছবিগুলো।
মূলত, হোয়াইট হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে তোলা ছবিগুলো জনাব পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা তার ফেসবুক আইডিতে ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭.৫০ মিনিটে প্রকাশ করেছেন। পোস্টে সংযুক্ত ৩ টি ছবির মধ্যে ১ম ছবিতে শুধুমাত্র তাকে দেখা গেলেও ২য় ছবিতে তার পাশে জুনাইদ আহমেদ পলককেও দেখা যায় এবং শেষ ছবিতে শুধু হোয়াইট হাউজ ভবন দেখা যায়।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো তাদের পেছনে থাকা হোয়াইট হাউজের সম্মুখ গেটের শীর্ষে একটি লাল ফিতা (Red Ribbon) ঝুলানো রয়েছে। লাল ফিতাটি ঝুলানোর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায় বিশ্ব এইডস দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে হোয়াইট হাউজের সামনের দিকে দিবসটির চিহ্ন হিসেবে এই লাল ফিতা (Red Ribbon) ঝুলিয়ে রাখা হয়। মূলত ২০০৭ সাল থেকে এই প্রথাটি চলমান।
২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে হোয়াইট হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে তোলা বেশকিছু ছবি খুঁজে পেয়েছে (পোস্টগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে) রিউমর স্ক্যামার টিম এবং ছবিগুলোর ব্যাকগ্রাউন্ডে হোয়াইট হাউজের সম্মুখের শীর্ষে ঝুলানো Red Ribbon পরিষ্কার দৃশ্যম্যান যার সাথে আরিফা জেসমিন কনিকার প্রকাশিত ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডের হুবহু মিল রয়েছে।
বিষয়টি আরো সহজে বলতে গেলে বিশ্ব এইডস দিবসকে কেন্দ্র করে হোয়াইট হাউজের গেটের মাঝামাঝি অংশে ২০০৭ সাল থেকে Red Ribbon ঝুলানো হয়। ২০২০ সালেও Red Ribbon গেটের মাঝামাঝি অংশেই ঝুলানো ছিলো কিন্তু এই সর্বপ্রথম ২০২১ সালের ডিসেম্বরে লাল ফিতাটি ( Red Ribbon ) গেটে মাঝামাঝি অংশের পাশাপাশি শীর্ষেও ঝুলানো হয়।
অর্থাৎ, হোয়াইট হাউজের গেটের শীর্ষে ঝুলানো লাল ফিতা সম্বলিত ছবিটি ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের ই এটি সম্পূর্ণ নিশ্চিত।
উল্লেখ্য, ডিসেম্বর মাস ছাড়া অন্য কোন সময়ে হোয়াইট হাউজের গেটে এই লাল ফিতা ঝুলানো থাকে না। ২০২২ সালের জানুয়ারির একটি ছবি দেখুন এখানে এবং এখানে।
ছবিগুলোর মেটাডাটা যাচাই পূর্বক অধিক নিশ্চিত হওয়ার জন্য জনাব জুনাইদ আহমেদ পলকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ইতিবাচক সাড়া দেন এবং ফেসবুকে প্রকাশিত ছবিগুলোর মূল কপি সরাসরি ইমেইলের মাধ্যমে রিউমর স্ক্যানারকে পাঠান। পরবর্তীতে, ছবিগুলোর মেটাডাটা পর্যবেক্ষণ করে তার ফেসবুক পোস্টে দাবি করা সময় ও স্থানের সাথে মেটাডাটা থেকে পাওয়া সময় ও স্থানের হুবহু মিল পাওয়া যায়।
অর্থাৎ, বোস্টন এবং ওয়াশিংটন থেকেই গতমাসে ছবিগুলো তুলেছেন তিনি।
এছাড়া, তাদের বোস্টন থেকে ওয়াশিংটন সফরের ফ্লাইট টিকিট কপি পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। টিকিট কপি দেখুন নিচে ( নিরাপত্তা জনিত কারণে কিছু অংশ মুছে দেয়া হয়েছে )
প্রসঙ্গত, জুনাইদ আহমেদ পলকের প্রকাশিত প্রায় সকল ছবিতেই লোকজনের মুখে মাস্ক ব্যবহার দেখা যাচ্ছে অর্থাৎ ছবিগুলো স্বাভাবিকভাবেই করোনাকালীন সময়ের। এছাড়া ছবিগুলোর মেটাডাটা যাচাই, ফ্লাইট টিকিট এবং হোয়াইট হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে তোলা ছবিগুলোর ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এটি পুরোপুরি নিশ্চিত যে ছবিগুলো গত ডিসেম্বর মাসের ই।
রিউমর স্ক্যানার টিম জনাব পলকের ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের সকল এক্টিভিটি পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হয়েছে যে তার সেসময়ে যুক্তরাষ্ট্র সফর ছিলোনা। তার ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর, ৫ ডিসেম্বর, ৭ ডিসেম্বর,৯ ডিসেম্বর ,১২ ডিসেম্বর ,১৩ ডিসেম্বর ,১৪ ডিসেম্বর ,১৫ ডিসেম্বর ,১৬ ডিসেম্বর ,১৭ ডিসেম্বর ,১৮ ডিসেম্বর ,২০ ডিসেম্বর ,২৪ ডিসেম্বর ,২৫ ডিসেম্বর , ২৭ ডিসেম্বর, ২৮ ডিসেম্বর,৩০ ডিসেম্বর তারিখের এক্টিভিটি দেয়া হলো।
অর্থাৎ, উপরোক্ত সকল তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী এটি পুরোপুরি নিশ্চিত যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক স্ব-পরিবারে গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন এবং তাদের প্রকাশিত সকল ছবি এই সফরের সময়েই তোলা হয়েছে। ছবিগুলো পুরোনো শীর্ষক দাবিটি পুরোপুরি মিথ্যা এবং তাকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে না দেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও গুজব।
তথ্য ও ছবি: রিউমর স্ক্যানার
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।