বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় গানের শিক্ষক নিয়োগ: ধর্মীয় শিক্ষার দাবি উপেক্ষিত কেন?

Seba Hot News : সেবা হট নিউজ
0

শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড, আর প্রাথমিক শিক্ষা সেই মেরুদণ্ডের মূল ভিত্তি। একটি জাতি তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কী ধরনের শিক্ষায় গড়ে তুলবে, তার ওপরই নির্ভর করে তার উন্নয়ন ও অগ্রগতি।

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় গানের শিক্ষক নিয়োগ: ধর্মীয় শিক্ষার দাবি উপেক্ষিত কেন?
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় গানের শিক্ষক নিয়োগ: ধর্মীয় শিক্ষার দাবি উপেক্ষিত কেন?



সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় একটি নতুন বিতর্কিত বিষয় উঠে এসেছে—তা হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গানের শিক্ষক নিয়োগ। সরকার শিশুদের মানসিক বিকাশ, সংস্কৃতিচর্চা ও বিনোদনের অংশ হিসেবে সংগীত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে একটি গভীর প্রশ্ন সামনে এসেছে: একই সময়ে দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে যখন ধর্মীয় শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, তখন এই সিদ্ধান্ত কি আমাদের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এটি কি সত্যিই শিশুদের স্বার্থে, নাকি এর আড়ালে অন্য কোনো স্বার্থ লুকিয়ে আছে?


সংগীত শিক্ষার প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনীয়তা

শিশুদের শিক্ষায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সংগীত নিঃসন্দেহে মানুষের মনকে প্রফুল্ল করে, সৃজনশীলতা বাড়ায় এবং মানবিক গুণাবলি বিকাশে সহায়তা করে। প্রাথমিক স্তরে সংগীত শিক্ষাকে যুক্ত করার পক্ষে যারা যুক্তি দেন, তারা বলেন—এটি শিশুদের মানসিক আনন্দ, সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় এবং শিল্পচর্চার মাধ্যমে তাদের মননশীলতা বাড়াতে সাহায্য করবে। এই যুক্তিগুলো অসার নয়। একটি উন্নত সমাজে শিল্প ও সংস্কৃতির চর্চা অপরিহার্য।


কিন্তু সমস্যা হলো, যখন একটি শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তরে গানের শিক্ষককে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, অথচ সমাজের মৌলিক চাহিদা অনুযায়ী ধর্মীয় শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক থাকে না, তখন তা দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও জনগণের মৌলিক বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। শিক্ষাব্যবস্থায় অগ্রাধিকারের ক্রম কী হবে—সেটা দেশের আর্থ-সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করা উচিত।


ধর্মীয় শিক্ষার অবহেলা: এক গভীর সংকট

বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ, যেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। দেশের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ অত্যন্ত গভীর। স্বাভাবিকভাবেই, প্রতিটি অভিভাবক চান তাদের সন্তান ছোটবেলা থেকেই ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ অত্যন্ত সীমিত। অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য কোনো বিশেষায়িত শিক্ষক নেই। এর ফলে, গণশিক্ষকরাই অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষা পড়ান, যা অনেক সময় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।


এই সংকটের কারণে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদেরকে কুরআন শিক্ষা ও মৌলিক ইসলামি জ্ঞানের জন্য স্কুলের বাইরে আলাদা মক্তব বা মাদরাসায় পাঠান। এর ফলে অভিভাবকদের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ তৈরি হয় এবং শিশুদের ওপর পড়াশোনার অতিরিক্ত বোঝা চাপে। প্রশ্ন হলো—যদি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করা যেত, তাহলে কেন অভিভাবকদের এই অতিরিক্ত চাপ ও খরচ বহন করতে হতো?


ধর্মীয় শিক্ষা কেবল ধর্মীয় জ্ঞান দান নয়; এটি শিশুদের নৈতিকতা, মানবিকতা, সৎ চরিত্র ও দায়িত্ববোধ শেখায়। সমাজের বর্তমান অবক্ষয়, যেমন—সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মাদক, জুয়া, ইভটিজিং ও নৈতিক স্খলন রোধ করতে শিশুদের মাঝে ইসলামি শিক্ষা অপরিহার্য। এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যথাযথ বিনিয়োগ না করে সংগীত শিক্ষায় অতিরিক্ত জোর দেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।


কার স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে? 

গানের শিক্ষক নিয়োগের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আসে, যা এই সিদ্ধান্তটিকে আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে:

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও আধিপত্য

অনেকেই মনে করেন, এই সিদ্ধান্তটি কোনো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর চাপ বা ভিন্নমুখী সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার একটি সুদূরপ্রসারী কৌশল। এর উদ্দেশ্য হতে পারে নতুন প্রজন্মকে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও পরিচয় থেকে দূরে সরিয়ে একটি পশ্চিমা ধাঁচের ভোগবাদী সংস্কৃতির দিকে ঠেলে দেওয়া। এর মাধ্যমে দেশের ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে দুর্বল করা হতে পারে।

অর্থনৈতিক স্বার্থ

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গানের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াটি একটি বিশাল অর্থনৈতিক কার্যক্রম। হাজার হাজার শিক্ষক নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ এবং বাদ্যযন্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ ক্রয়ের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়। এই বিশাল আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। এর ফলে, শিক্ষাখাতে যেখানে শিক্ষকের মৌলিক ঘাটতি রয়েছে, সেখানে অপ্রয়োজনীয় জায়গায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য

শিক্ষাব্যবস্থায় এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে সমাজের সেই নির্দিষ্ট শ্রেণির সমর্থন আদায় করা যেতে পারে, যারা ধর্মীয় শিক্ষাকে শিক্ষার মূলধারা থেকে দূরে রাখতে চায়।


ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষার অগ্রাধিকার

ইসলামে শিক্ষার প্রথম অগ্রাধিকার হলো ঈমান এবং ধর্মীয় জ্ঞান। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “তোমরা তোমাদের সন্তানদের প্রথম শিক্ষা দাও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।’” (হাদিস)


এই হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, শিশুদের জীবনের প্রথম এবং প্রধান শিক্ষা হওয়া উচিত তাওহিদের (একত্ববাদ) শিক্ষা, যা তাদের ঈমানকে মজবুত করবে। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন: “হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা করো।” (সূরা তাহরীম: ৬)


এই আয়াতটি প্রতিটি মুসলিমকে তাদের এবং তাদের পরিবারের জন্য নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে, যখন সংগীতকে বাধ্যতামূলক করা হয় এবং ধর্মীয় শিক্ষার দাবি উপেক্ষিত হয়, তখন এটি ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়।

জনগণের প্রত্যাশা বনাম সরকারের পদক্ষেপ

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ চান তাদের সন্তানরা নৈতিক, ধর্মপ্রাণ ও সুশিক্ষিত হয়ে বড় হোক। তারা তাদের সন্তানদের এমন একটি পরিবেশে দেখতে চান, যেখানে তারা তাদের ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। কিন্তু তারা যখন দেখেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নেই অথচ গানের শিক্ষক আলাদা করে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তখন তাদের মনে ক্ষোভ তৈরি হয় এবং তারা সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন।


এটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থার সংকট তৈরি করছে। অভিভাবকরা মনে করেন, সরকারের নীতিতে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন নেই; বরং অন্য কারো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

বাস্তব চিত্র ও বৈষম্য

শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্রও হতাশাজনক। গ্রামীণ অঞ্চলের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংকট রয়েছে। অনেক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককে একসঙ্গে বহু শ্রেণি পড়াতে হয়। কোথাও বিদ্যালয়ের ভবন নেই, শিশুদের বসার জায়গা নেই, পর্যাপ্ত পাঠ্যবই নেই। এসব মৌলিক সমস্যার সমাধান না করে গানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সাধারণ মানুষের কাছে অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য মনে হয়। এই পদক্ষেপের ফলে শহর ও গ্রামের বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বৈষম্য আরও বাড়তে পারে।

সমাধান ও করণীয়

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যাতে শিশুদের জাতীয় ও ধর্মীয় চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তার জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:

ধর্মীয় শিক্ষার জন্য আলাদা শিক্ষক নিয়োগ

প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কমপক্ষে একজন করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া জরুরি। এটি শিশুদের নৈতিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য এবং এটি অভিভাবকদের দীর্ঘদিনের দাবি।

ঐচ্ছিক সংগীত শিক্ষা

সংগীত পাঠ্যক্রমে থাকতে পারে, তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়; বরং ঐচ্ছিক হওয়া উচিত। প্রতিটি শিক্ষার্থী এবং তার অভিভাবক যেন তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী এই বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে পারে।

জনমতের প্রতিফলন ঘটানো

শিক্ষানীতি প্রণয়নে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। এমন কোনো নীতি গ্রহণ করা উচিত নয় যা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

নৈতিকতা ও চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষা

কেবল একাডেমিক জ্ঞান নয়, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ শেখানোর ওপর জোর দিতে হবে। এর জন্য প্রাথমিক স্তর থেকেই ইসলামী নৈতিকতাকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

প্রাথমিক শিক্ষায় বৈষম্য দূরীকরণ

শহর ও গ্রামের বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সুযোগ-সুবিধার যে বৈষম্য রয়েছে, তা দূর করা জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হয়।

শিশুদের স্বার্থে শিক্ষায় বিনিয়োগ হোক 

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় গানের শিক্ষক নিয়োগ একটি বহুল আলোচিত পদক্ষেপ। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—এই নিয়োগ কার স্বার্থ রক্ষা করছে? শিশুদের নাকি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর? যখন দেশে ধর্মীয় শিক্ষার মতো অপরিহার্য বিষয় অবহেলিত, তখন সংগীত শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।


প্রাথমিক শিক্ষাকে ইসলামি মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও জাতীয় সংস্কৃতির ভিত্তিতে সাজানো আজ সময়ের দাবি। সংগীত থাকুক, শিল্পচর্চা থাকুক—কিন্তু মৌলিক জায়গায় ধর্মীয় শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের দাবি উপেক্ষিত হলে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি ও নৈতিক সংকটে পতিত হবে। তাই আমরা চাই শিশুদের স্বার্থে শিক্ষায় বিনিয়োগ হোক।



সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী 

লেখক ও সমাজ গবেষক 



সূত্র: /সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশ্যে আপোষহীন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Know about Cookies
Ok, Go it!
To Top