
বাংলাদেশ-ভারতের মাঠের লড়াই শেষ হয়েছে। কিন্তু রেশ রয়ে গেছে এখনও। পত্রিকার পাতা থেকে শুরু করে পাড়ার চায়ের দোকান, পথেঘাটে, বাসে-গাড়িতে বিষয় একটাই, ক্রিকেট। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জয়-জয়কার। ভারত বধের জানা কাহিনিই রঙচঙ মিশিয়ে বারবার বলা, ‘যা খেলেছে না বাংলাদেশ, ভোলার নয়। ভারত বহুদিন মনে রাখবে।’
এমনটা ছিল না কয়দিন আগেও। যখন ভারতের রথী- মহারথী ক্রিকেটাররা ঢাকায় পা রেখেছেন, তখনও। ১৮ জুনের রাতের পর রাতারাতি সবই পাল্টাতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তন এসেছে সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস মুস্তাফিজুর রহমানের হাত ধরে। যেমনি সেজো ভাই মোখলেসুর রহমানের হাত ধরে তার এই পর্যন্ত আসা। শীতের রাতে এই ভাইয়ের মোটরসাইকেলে চড়ে ৪০ কিলোমিটার দূরের সাতক্ষীরা শহরে এসে অনুশীলন করতেন মুস্তাফিজ।
বাবা আবুল কাশেম গাজী চার-চারজন গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন, তবুও যদি ছেলে পড়াশোনায় মন দেয়। যার মন পড়ে আছে খেলার মাঠে, ভারত বধের নায়ক হবেন যিনি তার কি আর পড়ার টেবিলে মন বসে! মুস্তাফিজুরেরও বসেনি। বাবা-মার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঠিকই ছুটে গেছেন মাঠে। ভাগ্যিস তিনি সেদিন পালিয়ে মাঠে গিয়েছিলেন, তা না হলে বাংলাদেশকে বিস্ময়কর জয় এনে দিত কে? এই প্রশ্নে বাবা আবুল কাশেম যেন খুশিই হলেন। ‘গর্ব হচ্ছে বাবা, ওর জন্য গর্ব হচ্ছে।’ কণ্ঠ ধরে এলো বুঝি। না, একদম না। বললেন, ‘অনেক মেরেছি ছেলেকে। খেলবি না, খেলে কী হবে? ওর বড় ভাই ক্রিকেট খেলত। মেজো ও সেজোটাও খেলে। ওরা তো খুব বেশিদূর এগুতো পারেনি। যে কারণে বাধ্য হয়ে ছোটটাও ওই পথে যাক, চাইনি। কিন্তু মুস্তাফিজ যে এত সুনাম বয়ে আনবে, তা জানলে কি আর ফেরাতাম ওকে?’ এবার ঠিকই চোখের পানি মুছতে হলো ব্যবসায়ী বাবাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মাঠে কেউ একজন মুস্তাফিজুর রহমানকে বললেন বাংলাদেশের বিস্ময়। ওমনি কথা কেড়ে নিয়ে ঝেড়ে দিলেন পাশের জন। ‘বাংলাদেশ নয়, বলুন বিশ্বের বিস্ময়, বিশ্ব ক্রিকেটের বিস্ময়। বিশ্ব সেরা ব্যাটিং লাইনআপ ভারতকে তাসের ঘরের মতো তছনছ করে দেওয়ার পরও কি বলবেন মুস্তাফিজ কেবল বাংলাদেশের?’ ঠিকই তো, উনিশ বছরের এই বাঁহাতি পেসারের ঝুলিতে কী নেই? ইন সুয়িং, অফ কাটার, লেগ কাটার, মাপা স্লোয়ার। এত রকম ভ্যারাইটি এর আগে খুব কমই দেখেছে বিশ্ব ক্রিকেট। বাংলার আবিষ্কার হলেও মুস্তাফিজ এখন বিশ্ব ক্রিকেটের সম্পদ, আমাদের মহাতারকা।
একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশিদের মধ্যেও ওয়াসিম আকরাম কিংবা গ্ল্যান ম্যাগ্রার মতো পেসারের দারুণ জনপ্রিয়তা ছিল। বাঁহাতি পেসার ওয়াসিম আকরাম মাঠে নামলে টিভি পর্দা থেকে চোখ ফেরানোই দায় ছিল। সেই বাংলাদেশিদের মনে অবলীলায় জায়গা করে নিলেন মুস্তাফিজ। এখন বাঁহাতি পেসারের গর্ব করতে পারি আমরাও। সদ্য কৈশোর পেরিয়ে আসা ছেলেটি সেই সুযোগই করে দিলেন আমাদের।
ভারতের সঙ্গে প্রথম দুই ম্যাচের নায়ক তিনি। তৃতীয় ম্যাচেও পেয়েছেন দুটো উইকেট। সেই সুবাদে সিরিজ সেরার কৃতিত্বটাও পেয়েছেন তিনি। ক্রিকেট ভাষ্যকারের মাইক্রোফোন বারবার এগিয়ে দেওয়া হয়েছে তার দিকে। লাজুক বটে। দু-একটি বাক্য ছাড়া খুব বেশি বলেননি। সংবাদ সম্মেলনেও কাটছাঁট উত্তর দিয়ে শেষ করেছেন। ধোনি, রায়না, রাহান বধের নায়ককে দেখে মনেই হয়নি, তিন ম্যাচে ১৩ উইকেট কেটেছেন তিনি। মুস্তাফিজ কি এতটাই লাজুক? মা মাহমুদা খাতুন বললেন, ‘আমার মুস্তাফিজ লাজুক নয়। ও তো আমাদের সঙ্গে বেশ কথা বলে। তবে খুব যে চঞ্চল তাও না। ছোট বেলা থেকেই এমন।’ হতে পারে মুস্তাফিজের মূল মন্ত্র, ‘কথা কম, কাজ বেশি।’ কাজের কাজটি যিনি করিয়ে দেখাতে পারেন তার কথা কম বলাতেই বা কী আসে যায়।
ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ এক তারকার জন্ম দিয়েছে এর আগেই। টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিÑসব ফরম্যাটেই সাকিব আল হাসান র্যাংকিংয়ে এক নম্বর হয়েছেন একাধিকবার। সবশেষ র্যাংকিংয়েও তিনিই শীর্ষে। মুস্তাফিজ যে আগমনবার্তা দিয়েছেন তা ধরে রাখতে পারলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আরও একজনকে নিয়ে মাতামাতি হবে গোটা বিশ্বেই।
স্বপ্নের অভিষেক, বিশ্বরেকর্ড
প্রতিভা থাকলে তাকে ঠেকিয়ে রাখে কে? মুস্তাফিজুর রহমান তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। কারো কারো প্রতিভা থাকে জন্মগত। মুস্তাফিজ তাদের দলে। ক্রিকেট প্রতিভা নিয়েই তার জন্ম। সঙ্গে অদম্য স্পৃহা। যে কারণে কোনো প্রতিকূলতাই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
২০১৪ সালে অভিষেক হলো জাতীয় ক্রিকেট লিগে। কিন্তু প্রথম ম্যাচটা ভালো হলো না। তাতে কি, মনোবল অটুট রেখে সামনের দিকে এগুলেন। লিগ শেষে তার ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান দাঁড়ালো ১৮.০৩ গড়ে ২৬ উইকেট। ঘরোয়া লিগের এই পারফরম্যান্সই তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ডাক পেলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচে।
৪ ওভার বোলিং করলেন। মাত্র ২০ রান দিয়ে নিলেন ২ উইকেট। তার চেয়ে বড় কথা ২৪ বলের মধ্যে ১৬টিতে কোনো রানই নিতে পারেনি পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরা। এর বেশিরভাগ বলেই আবার ব্যাটে বলই লাগাতে পারেনি ব্যাটসম্যানরা। আফ্রিদিরা এদিনই অনুমান করতে পেরেছিলেন, এই ছেলে অনেকদূর যাবে। আর এর পরের কাহিনি তো সবার জানা। ডাক পেলেন ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে। প্রথম ম্যাচে ৫০ রান দিয়ে ৫ উইকেট। অভিষেক ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ।
সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন ঝলমলে অভিষেক কার হয়েছে, মনে পড়ছে না। উনিশ বছরের একটা ছেলের নামের পাশে পাঁচটা উইকেট। রোহিত, রাহান, রায়নার মতো ব্যাটসম্যানরা ঝুলিতে! সঙ্গে জাদেজা, অশ্বিন। হাতে চমকে দেওয়ার মতো অফকাটার, লেগকাটার। মাপা স্লোয়ার। নিখুঁত জায়গা। এত কিছু কিন্তু একটা নতুন ছেলের মধ্যে দেখা যায় না।
ভারত বনাম বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচে দ্বিধাহীনভাবে ম্যাচে সবার নায়ক মুস্তাফিজুরই। রোহিত শর্মার মতো ব্যাটসম্যান, যে আবার সেট হয়ে গিয়েছে, তাকে ভুল করতে বাধ্য করাটা সোজা ব্যাপার নয়। লেগ কাটারটা একেবারে জায়গায় পড়ল। রাহানের সময় অফকাটার। ওদের দুইজনকে ফিরিয়ে দেওয়াটাই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। এর আগে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল বোলারের নাম তাসকিন আহমেদ। মাত্র ২৮ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিয়েছিল। এবার নতুন নজির মুস্তাফিজুরের। ৯.২ ওভার বল করে ৫০ রান দিয়ে নিল ৫টা উইকেট।
দ্বিতীয় ম্যাচে কি করবে বাংলাদেশ, কেমন করবেন মুস্তাফিজ। পরীক্ষা ছিল বাংলাদেশ ও মুস্তাফিজের জন্য। সেই পরীক্ষায় লেটার মার্ক পেল বাংলাদেশ। আর মুস্তাফিজ একশতে একশ। মুস্তাফিজের কাটারে কাটা পারলেন ৬ ভারতীয়। মাত্র ২০০ রানে বিধ্বস্ত সফরকারীরা ৪৩ রান দিয়ে ৬ উইকেট নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে হইচই ফেলে দিলেন। ক্রিকেট আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলেন মুস্তাফিজুর রহমান। প্রথম দুই ম্যাচে ১১ উইকেট নয়া রেকর্ড। ক্রিকেট বিশ্বে নয়া আতঙ্ক।
তার বোলিং রহস্য
সবার চোখ এই তরুণ ফাস্ট বোলারের দিকে। কে এই মুস্তাফিজ? কি আছে তার বোলিংয়ে? কি কারণে ভারতের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানরা অসহায় আত্মসমর্পণ করছেন তার কাছে?
ক্রিকেট প-িতদের মতে, মুস্তাফিজুর রহমানের বোলিং রহস্য তিনটি। একটি হলো আউট স্যুয়িং। স্যুয়িংয়ের সঙ্গে আছে পেস। তার সঙ্গে স্লোয়ার অফ কাটার এবং ফাস্ট অফ কাটার। এই চারের সংমিশ্রণে ভয়ানক বোলার হয়ে ওঠেছেন তিনি। তবে মুস্তাফিজের প্রধান অস্ত্র হলো কাটার।
বোলিংয়ে কাটার শব্দটা নতুন কিছু নয়। এর আগেও অনেকে অফ কাটার, লেগ কাটার বল করেছেন। ইমরান খান করেছেন, ইয়ান বোথাম করেছেন। করেছেন ওয়াসিম আকরামও। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মিচেল জনসনও কাটার করে থাকেন। তাদের মধ্যে মুস্তাফিজুর রহমানের তফাৎ কি?
মুস্তাফিজুর রহমানের বল ব্যাটসম্যানরা খেলতে পারেন না কেনো? মুস্তাফিজ স্যুয়িংয়ের সঙ্গে দুই ধরনের কাটার যোগ করে বল করেন। একটা স্লোয়ার এবং অন্যটা ফাস্ট। বলের উপর রাখার তার দুই আঙুলের এতটাই মুন্সিয়ানা যে, কোনটা স্লোয়ার এবং কোনটা ফাস্ট সেটা বোঝা কস্টকর হয়ে দাঁড়ায় ব্যাটসম্যানদের। মানে বলে অসাধারণ ভেরিয়েশন আনতে পারেন তিনি। সর্বোপরি ক্রিকেট প-িতরা মত দিয়েছেন, তার বোলিং প্রতিভা প্রকৃতি প্রদত্ত।
সতর্ক কোচ
রাতারাতি প্রাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসা মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে সতর্ক বাংলাদেশের ফাস্ট বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিক। বাংলাদেশের বোলিং কোচের চাওয়া, এখনই যেন প্রত্যাশার ভার চাপিয়ে দেওয়া না হয় তরুণ বোলারের ওপর। কয়দিন আগে বাংলাদেশের ক্রিকেটেও খুব বেশি লোকে যাকে চিনত না, সেই মুস্তাফিজ এখন হইচই ফেলে দিয়েছেন গোটা ক্রিকেট বিশ্বে। বোলিং কোচের বিশ্বাস, ঠিকমতো যতœ পেলে অনেকদূর যাবেন মুস্তাফিজ। বলেছেন, ‘মুস্তাফিজ এখনও অনেক তরুণ। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। ২ ম্যাচে ১১ উইকেট পেয়েছে বটে, তবে প্রতি ম্যাচেই যেন ওর কাছে ৫ উইকেট প্রত্যাশা না করি আমরা। সম্ভাবনার প্রমাণ সে রেখেছে। এখন ওকে যদি আমরা ঠিকমতো দেখভাল করতে পারি ও পাশে থাকি, আমাদের জন্য অনেক বড় এক ম্যাচ উইনার হবে সে।’ স্ট্রিক জানান, মুস্তাফিজের বোলিং দক্ষতা বাড়াতে নেটে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন তিনি। ‘মুস্তাফিজকে নিয়ে আমি নেটে কাজ করছি। কারও সঙ্গে নিয়মিত কাজ করলে তার দক্ষতা বাড়বেই। এগুলো কোনো জাদুমন্ত্র নয়, লম্বা সময় ধরে ট্রেনিং করে গেলে দক্ষতা বাড়বেই। আমরা সেই চেষ্টাই করছি।’
অতি কোচিংয়ে মুস্তাফিজকে বিভ্রান্ত না করার ব্যাপারেও সতর্ক স্ট্রিক। বলেছেন, ‘কোচ হিসেবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন অতি কোচিংয়ে ওকে ভারাক্রান্ত না করা হয়। ¯্রফে পথ দেখাতে হবে ওকে। কিছু প্রয়োজন হলে সাহায্য করতে হবে। ওকে ব্যবস্থাপনায় আমাদের সাবধানী হতে হবে।’
মুস্তাফিজের সেই ১৩ বল
তিন ম্যাচে ভারতীয় ১৩ ব্যাটসম্যান কে কীভাবে আউট হয়েছিলেন তা দেখে নিন :
প্রথম ম্যাচ
১. ম্যাচের মোড় ঘুরাতে উইকেট দরকার ছিল। ঠিক তখনই জ্বলে উঠলেন মুস্তাফিজুর রহমান। নিজের পঞ্চম ওভার বোলিং করতে এসে দারুণ এক স্লোয়ার কাটার। বল পড়ে তা বাম দিকে মোড় নেয়। রোহিত বুঝতেই পারেননি। পুরোপুরি বোকা বনে জান। বল উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটাই প্রথম উইকেট মুস্তাফিজের।
২. পরের ওভারে আরেক উইকেট। এবারও কাটার। রোহিতের মতো অজিঙ্কে রাহানেও বুঝে ওঠতে পারেননি। ব্যাটসম্যান হয়ত ভেবেছিলেন বলটা দ্রুত আসবে। কিন্তু এটাও ছিল স্লোয়ার কাটার। ঠিকমতো মারতে পারেননি রাহানে। ক্যাচ তুলে দেন। নাসির তা লুফে নিতে ভুল করেননি।
৩. তৃতীয় স্পেলে বোলিং করতে এসে আরো অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন মুস্তাফিজ। ৩৭তম ওভারের চার নম্বর বলটিও কাটার করলেন। রায়না সেটা বুঝতেই পারলেন না। ড্রাইভ করতে গেলেন। কিন্তু বল বাক নিয়ে স্ট্যাম্প ফেলে দেয়।
৪. পরের বলে অশ্বিনকে আউট হরে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা জাগান মুস্তাফিজ। এটাও ছিল কাটার। বলটা ছিল স্লো। বলটা ঠিকঠাক মোকাবেলা করতে পারেননি অশ্বিন। সামনেই ক্যাচ ওঠে যায়। সেটা নিজেই লুফে নেন মুস্তাফিজ।
৫. এটাও ছিল স্লোয়ার বল। কিন্তু আগে থেকে বোঝার উপায় ছিল না। রবিন্দ্র জাদেজাও বুঝতে পারেননি। ক্যাচ তুলে দেন সৌম্য সরকারের কাছে। এভাবেই অভিষেক ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়ে সাড়া ফেলে দেন মুস্তাফিজ।
দ্বিতীয় ম্যাচ
৬. ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই রোহিত (০) বোকা বনে যান প্রথম ম্যাচের নায়ক মুস্তাফিজের কাছে। বলটি ছাড়ার আগে স্পিনারের মতো ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। হাফভলি-টাইপের ওই বলে দুর্বল ড্রাইভ করেন রোহিত। বল মাঝব্লেডে না লাগলে চলে যায় শর্ট পয়েন্টে দাঁড়ানো সাব্বিরের দিকে। কিছুটা ঝাঁপিয়ে দুর্দান্তভাবে তালুবন্দি করেন তিনি।
৭. নিজের দ্বিতীয় স্পেলে, ৩৬তম ওভারের তৃতীয় বলে সেই ‘বিষাক্ত’ কাটার মারেন সাতক্ষীরার এই তরুণ। বলটি বেশ শর্ট ছিল। পিচ করেই টেনিস বলের মতো লাফিয়ে ওঠে। রায়না সেকেন্ডস্লিপ খালি জেনেই খোঁচাতে চেয়েছিলেন। বল কানায় লেগে উইকেটরক্ষক লিটনের হাতে চলে যায়। দলকে বিপদে রেখে ৩৪ রানের মাথায় ফিরতে হয় রায়নাকে।
৮. রায়না ফিরে গেলে সিঙ্গেল নিয়ে স্কোর বড় করার পাঁয়তারায় থাকা ধোনিকে গত ম্যাচের ‘জবাব’টা দিয়ে দেন আরেকটি ‘কাটারে’। ৪০তম ওভারের তৃতীয় বলে কাটারে বিভ্রান্ত হয়ে শট কাভারে সৌম্যের হাতে ক্যাচ তুলে দেন ভারত দলপতি। ঠিক প্রথম ম্যাচে রোহিত যেভাবে মাশরাফিকে ক্যাচ দিয়েছিলেন।
৯. ধোনিকে আউট করার পরের বলে অক্সর প্যাটলকে গোল্ডেন ডাকের স্মৃতি উপহার দেন মুস্তাফিজ। সিম-আপ ডেলিভারিতে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেন। প্রথম ম্যাচের মতো এদিনও সম্ভাবনা জাগান হ্যাটট্রিকের।
১০. হ্যাটট্রিক করতে না পারলেও নিজের পরের ওভারে ‘ব্যাক টু ব্যাক’ পাঁচ উইকেট তুলে নেন। ঢুকে পড়েন ইতিহাসে। ওয়ানডের মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেকসহ দ্বিতীয় ম্যাচে পাঁচ উইকেট নেন তিনি। অশ্বিন তার কাটারে ভড়কে গিয়ে কট-বিহাইন্ড হন।
১১. মুস্তাফিজ শেষ উইকেট পান নিজের দশম ওভারের শেষ বলে। খেলা তখন ৪৪তম ওভারে। পাঁচটি বল হতেই বৃষ্টি নামে। খেলা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বৃষ্টির পর ওভারের শেষ বলটি করতে আসেন মুস্তাফিজ। সামনে জাদেজা। বলটি ছিল স্ট্যাম্প-টু স্ট্যাম্প বরাবর। জাদেজা কোনোমতে ঠেকিয়ে রান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বল ব্যাট ফাঁকি দিয়ে প্যাডে আঘাত হানে। তারপর স্ট্যাম্পে। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে পরপর দুই ম্যাচে প্রথমবারের মতো ১১ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব দেখান বাংলাদেশের ‘শত জনমের পাওয়া’ মুস্তাফিজ।
তৃতীয় ম্যাচ
১২. সেই মুস্তাফিজকে এ ম্যাচেও এড়াতে পারেননি রোহিত শর্মা। এই নিয়ে তিন ম্যাচে তার কাটারে কাটা পড়েন। শরীরের কাছাকাছি থাকা শর্ট বলে বড় শট খেলতে চেয়েছিলেন রোহিত। বল ব্যাটের কানায় চুমু দিয়ে চলে যায় লিটন দাসের গ্লাভসে। ২৯ রানের মাথায় ফিরতে হয় দুটি দ্বিশতকের মালিককে।
১৩. এরপর ব্যক্তিগত দশম ওভারে রায়নাকে (৩৮) ক্লিন বোল্ড করে নিজের দ্বিতীয় উইকেট দখল করেন গত দুই ম্যাচে ১১ উইকেট নেয়া মুস্তাফিজুর। দারুণ এ বলটিও বুঝতে পারেননি রায়না। তিন ম্যাচ সিরিজে মোট ১৩ উইকেট দখল করে ইতিহাসে নাম লেখান সাতক্ষীরার এই তরুণ। এর আগে হ্যারিস তিন ম্যাচে নিয়েছেন ১৩ উইকেট। তবে সেটা ছিল পাঁচ ম্যাচের সিরিজ। হ্যারিস খেলেছিলেন তিন ম্যাচ।
গ্রেটদের প্রশংসা
গোটা বিশ্বের জন্যই এক বড় চমকের নাম মুস্তাফিজুর রহমান। বাঁহাতি এই পেসার ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ওয়ানডেতেই ১১ উইকেট নেওয়ার পর তাকে নিয়ে চলছে হইচই। সেই মিছিলে শামিল ভারতের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক কপিল দেব। বাংলাদেশ-ভারত সিরিজে কিংবদন্তি এই অলরাউন্ডার ছিলেন ধারাভাষ্য কক্ষে। দ্বিতীয় ম্যাচের দিন তিনি মুস্তাফিজের তুলনা করলেন ওয়াসিম আকরামের সাথে। চমকে গিয়ে বললেন, ‘আরে এ তো ওয়াসিম আকরাম বোলিং করছেন, এ ছেলে অনেক লম্বা রেসের ঘোড়া।’
ইতিহাস গড়া পেসার মুস্তাফিজুর রহমান ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ শেষেই সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, তার আদর্শ পাকিস্তানের নিষিদ্ধ বোলার মোহাম্মদ আমির। অন্যদিকে মুস্তাফিজের আদর্শ হতে পেরে আনন্দিত ও সম্মানিতবোধ করছেন বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ আমির।
এ ব্যাপারে আমির বলেন, ‘মুস্তাফিজের কথা শুনে অনেক ভালো লাগছে। আমার কাছে মনে হয়েছে সে (মুস্তাফিজ) অসাধারণ একটি ক্যারিয়ারের জন্য তৈরি, কারণ বোলার হিসেবে অনেক কঠিন। ক্রিকেটীয় বুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানকে আটকানোর জন্য সবধরনের অস্ত্র তার রয়েছে।’ মুস্তাফিজের প্রশংসা করেন ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিও। বলেছেন, ‘সে ভালো একজন বোলার। হাতের গতি ভালো। ওর স্বাভাবিক গতির বল আর স্লোয়ারে কোনো পার্থক্য টের পাওয়া যায় না।’ অন্য পেসারদের স্লোয়ার সাধারণত উইকেটরক্ষকের সামনে পড়ে বা নিচু হয়। কিন্তু মুস্তাফিজের ক্ষেত্রে বল উইকেটরক্ষক পর্যন্ত যায় আর বাউন্সও ঠিক থাকে। এটা কিভাবে হয় উত্তরটা জানা নেই এক দশকের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা ধোনিরও। আসলে মুস্তাফিজের এই গুণটা প্রকৃতি প্রদত্ত।
সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তারালি ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া গ্রামের ছেলে মোস্তাফিজ। বরেয়া মিলনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন। অনূর্ধ্ব-১৬, ১৮ ও ১৯ সাতক্ষীরা জেলা দলে খেলতেন। ব্যবসায়ী বাবা আবুল কাশেম গাজী, মা মাহমুদা খাতুনের ঘর আলো করে ১৯৯৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয় মুস্তাফিজ। চার ভাই ও দুই বোনের সংসারে বেড়ে উঠা মুস্তাফিজের। তার বড় ভাই গ্রামীণফোনের টেরিটরি অফিসার, মেজো ও সেজো ভাই ঘের ব্যবসায়ী। তার ক্রিকেট খেলায় আসার পেছনে সেজো ভাই মোখলেসুর রহমানের অবদান অনেক। ক্রিকেট পরিবারে জন্ম নেওয়া মোস্তাফিজকে তাকাতে হয়নি পেছনে ফিরে। তার বড় ভাই এক সময় ক্রিকেট খেলতেন, মেজো ভাইও কম যান না, আর সেজো ভাই এখন ক্রিকেট খেলেন।
ভাইয়ের এই অবদানের কথা অকপটেই স্বীকার করলেন মুস্তাফিজ। বলেন, ‘আমার এখানে আসার পেছনে সেজো ভাই মোখলেসুর রহমানের অনেক অবদান আছে। তিনিই আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি আমার পাশে না থাকলে আমি এখানে আসতে পারতাম না।’ ক্রিকেট ভাষ্যকারের মাইক্রোফোন এগিয়ে এলে এটুকু বলেই ক্ষ্যান্ত হননি, স্মরণ করেছেন, পরিবারের কথাও। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন পরিবারের অন্যদের প্রতিও। যদিও প্রথম দিকে মোটেও অনুকূল পরিবেশ পাননি সাতক্ষীরা সীমান্ত ছোঁয়া এলাকার ছেলেটি।