সেবা ডেস্ক: সাহিত্যের নানাবিধ শাখার মধ্যে একমাত্র কবিতারই দু’টি শক্ত ডানা আছে। সে উড়ন্ত, সতত চঞ্চল, সচল, জঙ্গম ও অস্থির। অন্যগুলি যেমন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, আলোচনা ইত্যদি স্থবির, স্থিতিশীল, অনড় ও নিশ্চল। তবে দু’টিই যার যার স্থানে অনন্য ও সমভাবেই আদৃত। যে যার ভক্ত!
![]() |
কবি আলী জহির (বামে) ও লেখক আবদুল্লাহ আল-হারুন |
‘When a poem flows, earth shivers, mind gets wing and we don’t know to what destination we are flying’---Rainer Maria Rilke - Famous German poet (1875-1926)
যখন একটি কবিতা বয়ে চলে, পৃথিবী কাঁপে, মন মেলে পাখনা এবং আমরা জানিনা কোন গন্তব্যে আমরা উড়ছি’--রাইনার মারিয়া রিলকে - প্রখ্যাত জার্মান কবি (১৮৭৫-১৮২৬)
সাহিত্যের নানাবিধ শাখার মধ্যে একমাত্র কবিতারই দু’টি শক্ত ডানা আছে। সে উড়ন্ত, সতত চঞ্চল, সচল, জঙ্গম ও অস্থির। অন্যগুলি যেমন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, আলোচনা ইত্যদি স্থবির, স্থিতিশীল, অনড় ও নিশ্চল। তবে দু’টিই যার যার স্থানে অনন্য ও সমভাবেই আদৃত। যে যার ভক্ত!
আমি গত প্রায় ছয়মাস ধরে আমার প্রিয় শহর জামালপুর, শহরতলী এবং প্রান্তিক অঞ্চলের নবীন ও প্রবীন কবিদের, যাদের খোঁজ আমি মূলত ফেসবুক থেকে পেয়ে থাকি, কিছু কবিতা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে স্থানীয় বন্ধুদের নিয়মিত শোনাই।
বর্তমান ইউরোপ সাহিত্যের ব্যাপারে অনুৎসাহী, অনাসক্ত। জার্মানিতে প্রায় প্রতিটি শহরেই দৈনিক পত্রিকা আছে। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পত্রপত্রিকা আছে। কিন্ত সামান্য কয়েকটি আঞ্চলিক পত্রিকায় নিয়মিত-অনিয়মিত সাহিত্যের পাতা আছে।
কিন্ত অযত্ন ও অবহেলার ছাপ সুস্পষ্ট। কবিতা নেই বললেই চলে। জার্মানের অর্ধেকের বেশী জনসাধারন আবিটুর (আমাদের এইচএসসি) পাশ করে কচিৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। একটি মন মতো এবং ’চাহিদা আছে যে পেশার’ তার টেকনিকাল স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়ে (সাথে সাথে কোন ফার্মেূ হাতকলমে শিক্ষানবিশী করে) যত দ্রুত সম্ভব অর্থ রোজগারের পথ খুঁজে নেয়।
ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই জনসাধারনের মধ্যে এখন দক্ষ শ্রমিকদের স্যংখ্যাই বেশী। এরা সাহিত্যের ধার ধারে না। স্থিতিশীল সরকার, আইনের শাসন। ভালো রোজগার, মেডিকেল বীমা। নিজস্ব বাড়ী বানানো, গাড়ী ও মনমত নারীর সাথে সংসার গঠন করাতেই বেশী মনোনিবেশ করে। কিছু স্ক্যান্ডাল, হলুদ পত্রিকা আছে। চটি উপন্যাসও আছে যার সাহিত্য-মুল্য প্রশ্নসাপেক্ষ।
বছরের ছয় সপ্তাহের ছুটিতে আর্থিক অবস্থানুযায়ী দেশের ট্যুরিষ্ট স্পটে বা বিদেশে বেড়াতে যায়। ডিভোর্স এখন শতকরা ৩২%। সন্তানেরা প্রাপ্তবয়স্ক হলেই বাবা-মাকে ছেড়ে নিজস্ব অস্তিত্ব গড়তে ব্যস্ত হয়ে যায়। একান্নবর্তী পরিবার তো রূপকথা! অবসর নিয়ে বাবা-মারা যাদের সামর্থ আছে, তারা নিজেদের বাড়ীতেই থাকে, অন্যরা বৃদ্ধাশ্রমে। ’পরিবার’ বলতে আমরা যা বুঝি তা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সাথে সাথেই অন্তর্হিত হয়ে গেছে।
অধিকাংশ মৃত্যুই হয় হাসপাতালে বা হজপিস ভবনে। একেকটি মানুষ বিরাট, বিশাল এক মহাসাগরে একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ! অজ্ঞাত, অচেনা, নিরালা, নিরব মৃত্যু নিত্যনৈমিত্তিক। তবে অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় বা রাস্তায় কেউ মরে না। সরকার এসব ক্ষেত্রে খুবই সজাগ।
নির্বাচনের আগে যেসব ওয়াদা করেন, তার প্রায় সবই পূর্ণ করেন। আমাদের মতো নয়! স্বচ্ছলতা বিভিন্ন রূপে বিরাজমান। কেউ কারো কাছে হাত পাতে না। আত্মনির্ভরশীলতা আধুনিক ইউরোপে সৃদৃঢ়ভাবে গ্রোথিত। মনে আমাদের মতো কোন ’ক্লাসিকাল’ দুঃখ নেই। দুরারোগ্য ব্যধিতে দৈহিক কষ্ট আছে কিন্ত সুচিকিৎসাও আছে।
আমাদের দেশের মতো অপারেশনে লাখ লাখ টাকা কোন হাসপাতাল দাবী করে না। কাজেই হ্রদয় যেখানে ব্যথামুক্ত, প্রেমের ব্যর্থতা যেখানে অনূভুত হয় না, অর্থাভাব নাই, যাতায়াত ব্যবস্থা সর্বদা সচল, মাথার উপর সবারই ছাদ আছে। সেখানে কবিতা পড়ার মতো মানসিকতা কেন থাকবে?
গত ছয়মাসে আমি আমার প্রিয় শহর জামালপুর ও আশেপাশের ১২-১৩ জন কবির কবিতা জার্মানিতে অনুবাদ করে আমাদের সিনিয়র ক্লাবের সদস্যদের শুনিয়েছি। তারা মোহিত, আশ্চর্যান্বিত, বিষ্মিত! যে দেশে অনাহার, বিনা চিকিৎসা প্রায় সর্বজনীন, সমাজের সর্বত্র অনাচার, কদাচার, অভাব, দুর্নীতি, সেখানে একটি জিলা শহরে এত কবি এত কবিতা? যখন বলি আমাদের বাৎসরিক বইমেলায় হাজার হাজার কবিতার বই প্রকাশিত হয়, যেসব কবির কবিতা আমি তাদের শোনাই, তাদের সবারই ইতোমধ্যে একধিক কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে, তাদের চক্ষু বিস্ফোরিত হয়, চোখেমুখে অবিশ্বাস! অনেকে কবিতা কি, তাই আগে বুঝত না।
সারাজীবন কলকারখানায় অবিরাম একই মেশিনে কাজ করেছে। মোটা পেনশন নিয়ে নিজের বাড়ীতে, গাড়ীতে সুখের জীবন যাপন! কেউ বিধবা, কেউ সধবা, কেউ ব্যাচেলর, কেউ তালাকপ্রাপ্ত! কিন্ত সাহিত্যের জগতে কখনই কেউ ঢোকেনি। এখন বৃদ্ধ বয়সে আমার কাছে কবিতা কি এবং কেন, সেসব লেকচার আগ্রহ নিয়ে শোনে। কবিতার বিষয়বন্ততে তারা বিহ্বল, বিষ্মিত, হতভম্ব, বিমুগ্ধ! পেটে ক্ষুধা নিয়ে এসব রোমান্টিক বিষয় নিয়ে ছন্দ আর পয়ারের জগতে আনাগোনা? আমাদের মস্তিস্কের সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে!
তাদের উৎসাহ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মাসে একবার সিনিয়ররা সবাই একত্রিত হয়ে ক্লাবের নানা বিষয়ে বার্তালাপ করে। সভার শেষে ভুরিভোজনের সাথে বাংলা কবিতা, অনুবাদসহ শোনে। দাবী উঠেছে এখন আবদুল্লাহর (আমি) আয়োজনে মাসে একবার করে শুধুই কবিতার আসর করতে হবে। প্রস্তাবটি বিবেচনাধীন। কিন্ত আমি আপত্তি করেছি। শরীর জরাক্রান্ত। দুর্বল। দেহের ভারসাম্য নেই। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে পারি না। কাজেই মাসে দু’বার (মাসিক সভায় ও আরেকবার শুধু কবিতা-সন্ধ্যা) সঞ্চালন করতে আমি অপারগ।
উৎসের সন্ধানে
বহমান নদীর উৎস পেতে হলে উজানে, স্রোতের বিপরীত দিকে সন্ধান করতে হয়। আমি এ যাবত নবীন-প্রবীন কবিদের কবিতা অনুবাদ করেছি। সম্ভবত, আমি নিশ্চিত নই, এদের মধ্যে (হয়ত) মুজাহিদ বিল্লাহ ফারুকী বয়োজ্যেষ্ট। আমার ভুল হয়ে থাকেলে আগেভাগেই ক্ষমা চেয়ে রাখছি। তবে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি প্রবীন কবি আলী জহির, আমি যাদের কবিতা অনুবাদ করেছি, তাদের মধ্যে সবচাইতে বেশী বয়স। আমি তার এবং আমার আত্মীয় জাহাঙ্গীর সেলিমের সাথে একসাথে সেই ২০০৮ সালে পরিচিত হই। আমার প্রথম প্রকাশিত বই, ’প্রবাসে দৈবের বশে’। তার প্রকাশনা উৎসব আয়োজন করেছিল জামালপুরে আমার নবীন ও বয়স্ক বন্ধুরা। জাহাঙ্গীর সেলিম উদ্যোক্তদের মধ্যে অত্যন্ত সক্রিয় কর্মী। আলী জহির একটি সুন্দর বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তখনি বুঝেছিলাম, ’জাত কবি’, অনেক জানাশোনা। পরে জেনেছি, কবিতা ছাড়াও তিনি জামালপুরের অনেক মুল্যবান, সামাজিক, হারিয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক তথ্য নিয়ে বই লিখেছেন। কোথায় কোন বইয়ে রবীন্দ্রনাথ জামালপুরকে উল্লেখ করেছিলেন, তাও বহু খোঁজাখুঁজি ও গবেষনার পর বের করেছেন। আমি নিজেকে একজন নিবেদিতপ্রাণ রবীন্দ্র-প্রেমিক মনে করি। কিন্ত আমিও এটা কখনও জানতাম না!
আলী জহির বিনয়ী, কিছুটা প্রচারবিমূখ, স্বল্পভাষী, বন্ধুবৎসল, স্কুল বইয়ের সংজ্ঞায় কথিত আপাদমস্তক ’ভদ্রলোক’, নিঃশত্রু। মনে হয় জীবনে একটা মাছিও মারেননি। নিঃসন্দেহে বর্তমানে বাংলাদেশের বয়োজ্যেষ্ঠ প্রতিভাবান কবিদের তিনি অন্যতম এবং জামালপুরে হয়ত সবচাইতে প্রবীন। কাজেই তার বর্তমান ভুমিকাটি স্থানীয় তরুণ কবিদের জন্য অভিভাবকের মতো।
বর্তমান বাংলা কবিতার বিষয়বস্তুর বর্ণাঢ্য অসাধারণ সব বৈচিত্র্য তার এই আলোচ্য কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে। খুবই সাধারণ একটি চিত্র তার কবিতার কথায়, সহজ সরল অভিব্যক্তিতে এবং কৃষক-শ্রমিকের অনায়াস বাক-ভঙ্গিমায় প্রস্ফুটিত। কবিতাটি পড়ে আমার বহু আগে উনিশ শতকের গোড়ার কবি প্যারিচাঁদ মিত্রের (বুড়ো শালিকের ঘাগে রোঁ) কথা মনে পড়ে গেল। বঙ্কিমের দাঁত ভাঙ্গা সংস্কৃত-বাংলার অভিনব মিশ্রন- অসুর্যম্পর্সা, প্রোষিতভর্তিকা ইত্যাদির যোগ্য জবাব ছিল প্যারিচাঁদ মিত্রের কথ্য ভাষায় সাহিত্যবৃত্তি! এই দিক বিচেনায় আনলে, অবশ্যই বলতে হবে- আলী জহির তার কবিতায় যে সব শব্দচয়ন করেছেন, সেসব নাগরিক-বিদগ্ধদের পছন্দ না হলেও বাংলাদেশের আপামর খেটে খাওয়া, নির্যাতিত, নিপীড়িত গণমানষের মুখের কথাকে তিনি সাহিত্যের পঙক্তিতে সামিল করেছেন। প্রশংসার্হ দারুন সাহস, দরদ, বেপরোয়া এবং সন্দেহাতীতভাবে সাধারণ মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার অকাট্য প্রমাণ।
আমার জন্য তার আরো একটি সংবেদনশীল, অন্তরঙ্গ ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। তিনি আমার পরমপ্রিয় বাল্যবন্ধু প্রয়াত ডাক্তার মীর আবুল হাসান মাসুমের ছোট বোনকে বিয়ে করেছেন। মাসুম আমার কাছে এখনও একটি বিষ্ময়কর চরিত্র। সৎ, সহজ ও সরল এবং আমাকে সে একটা বিশেষ দৃষ্টিতে দেখত। আমি ওর মত সত্যবাদি ছিলাম না। বিশেষ প্রয়োজনে ও পরিস্থিতিতে আমি অনায়াসে মিথ্যা কথা কলতে পারতাম, এখনও পারি। তবে এদেশে ওটার আর দরকার হয় না। মাসুমকে বোমা মারলেও একটা অসত্য কথা বলানো যেত না। তার ঈশ্বরপ্রেম ছিল অবিশ্বাস্য। স্কুলে পড়ার সময়ই নিয়মিত নামাজ-রোজা পালন করত। কিন্ত আমার সাথে মিশতে তার কোন অসুবিধাই হতো না। আমি ধর্মকে এড়িয়ে চলতাম এবং মাসুম আমাকে এ জন্য কোনদিন কোন কথা বলেনি। অন্যের মুখে শুনেছি, কেউ আমার দুর্নাম বা সমালোচনা করলে মাসুম তার সরবে প্রতিবাদ করত। ক্রোধে চিৎকার করে বক্তাকে প্রায় প্রহারে উদ্যত হতো। তার মতে আমি নাকি বিধাতার একটি বিশেষ সৃষ্ট অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ। আমাকে বোঝার মতো ক্ষমতা নাকি খুব কম লোকেরই আছে, ইত্যাদি। এই সব কথা মনে হলে এখনও আমার চক্ষু সজল হয়ে আসে। সামনের বছর দেশে যাবার পরিকল্পনা আছে। দুর্ভাগ্য, মাসুম কয়েক মাস আগেই ইহলোক ত্যাগ করেছে। এ পৃথিবীতে তার সাথে আমার আর শেষ দেখাটি হল না। তবে ওপারে হবেই। জামালপুরে যাবো। আলী জহিরের স্ত্রী- আমার ছেলেবেলার ছোট্ট বোনটিকে প্রাণভরে শেষবার দেখে আসব। ২০০৮ সালে জামালপুরে তাকে দেখেছিলাম। একটি গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা করত। আমার আরেকটি প্রিয় বোন রীণা ছিল তার সহকর্মী। তার সাথেও দেখা হবে।
আলী জহিরের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমি বেশ দ্বিধাগ্রস্থ। কারণ একটাই। তার এই কবিতাটি ছাড়া আর কোন কবিতাই এখনও আমার পড়া হয়নি। ২০০৮ সালে জামালপুরে আলী জহির এবং জাহাঙ্গীর সেলিম, দুজনেই আমাকে তাদের একটি করে কবিতা দিয়েছিল। বহু বছর আগের কথা। কিছুই মনে নেই। কি বিষয়ে, কবিতার বাহির-ভেতরের কথা সব বিস্মৃত। তবে জাহাঙ্গীরের কবিতাটি ছিল আমাকে নিয়ে লেখা। ২০০৮ সালের জামালপুর শহরে আমার সফরের কাহিনীর বেশ কিছু বিবরন আমি আমার বই ’হ্রদয় মিশেছে মৃত্তিকায় (২০১০)’ লিপিবদ্ধ করেছি এবং ওই বইতে জাহাঙ্গীরের কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। কিন্ত বইটি এখানে আমার কাছে নেই। বইতে আলী জহিরের কথাও উল্লেখ করেছিলাম।
আমার লেখাটির জন্য ঢাকা থেকে তরুন বন্ধু শাহ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আলী জহিরের এই ’অবিনাশী শক্তির জোর’ কবিতাটি পাঠিয়েছে। এটাই এখানে আলোচনা করব। ভবিষ্যতে ২-৩টি কবিতার বই যদি হাতে পাই, সেসব পড়ে আলী জহিরের কাব্য প্রতিভা নিয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়াস করার একটি বাসনা আছে। এই লেখাটির তথ্য হিসেবে মনিরুজ্জামান, আলী জহিরকে নিয়ে তার একটি লেখা আমাকে পাঠিয়েছে। ওখান থেকে কিছু নির্বাচিত অংশ এখানে উদ্ধৃত করলাম। আপাতত পাঠকরা (যারা তার কবিতা এখনও পড়েননি) এসব থেকেই আলী জহিরকে উপলব্ধি করতে পারবেন, আশা করি।
(সুহৃদ লেখক শাহ্ মনিরুজ্জামানকে নিবেদিত)
আর বছরে দেখেছি দোনে উঠছে পানি
এখন গলগল করে পাম্পে ছুটছে পানি
খাল বেয়ে আলের পাশ দিয়ে প্রবাহী জল
ক্ষেতের জলে ডানা ঝাপটায় সড়ক-শালিক
কুঁয়াশাত ঢাকা বরেন্দ্রের আকাশ
আঙিনার দু’প্রান্তে পড়ে আছে বাঁশের খুঁটবেড়া
মেওয়া কয়েতবেল পাপলোশ লেবুর পাতায় জমে শিশির
অবিরত ডেকে যায় কবুতর, ঘুঘু পাখি
গোবরে নিকানো উঠোনে চরে বেড়ায় মুরগি ছানা
ঘুটের জ্বালানিতে আগুন জ্বলে
বাদাড়ে ছুটে বেড়ায় বেজি-কাঠবিড়ালী
আকাশে মালকুস্তি খায় খেলাড়ী কবুতর
সংসারে বহে চোরা স্রোত
নদীত জাগে না ঢেউ
মানুষের মন হাহাকারে ডুবে
তবুও পেশিতে জমে অবিনাশী শক্তি জোর*
--------------------------------------------------------------
দোনে- বাঁশের নির্মিত পা দিয়ে প্যাডল করে শাছ ধরার গ্রামীণ কাঠামো-যন্ত্র। এক ধরণের লোক প্রযুক্তি।
কুঁয়াশাতে- শিশির, শীতকালে বরফের আগমণী, পাপলোশ লেবু- বাতাবি লেবু।
অবিনাশী শক্তির জোর কবিতাটি কবি আলী জহিরের, ’জলদা সুন্দরীর কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুুক্ত।
জার্মান অনুবাদ
(Gewidmet meinem lieben Schriftsteller Moniruzzaman)
Fussbambugliederung geflossen war.
Nun strömt das Wasser mit der Pumpe
Wasser fließt entlang des Kanals und neben dem Bier
Der Straßenzaunkoenig schlägt mit den Flügeln im Wasser der Felder
Bambuszäune liegen zu beiden Seiten des Hofes.
Tau sammelt sich auf den Blättern der fruchttragenden
Steinapfel (Frucht) und der Papalosch-Zitrone.
Hühner grasen auf dem mit Mist getränkten Hof.
Feuer brennen auf dem Brennstoff der Hütte.
Fledermäuse und Eichhörnchen rennen auf den Feldern umher.
Ein Strom fließt durch die Welt.
Der Fluss steigt nicht in Wellen.
Der menschliche Geist ertrinkt in Klagen.
Dennoch sammelt sich in den Muskeln unzerstörbare Kraft.
বাংলাদেশের গ্রামের সাধারন দৈনন্দিন দৃশ্য এই কবিতাটিতে অপূর্ব মুন্সিয়ানায় বিবৃত করেছেন আলী জহির। বেশ কিছু শব্দ টিপিকাল যা (হয়ত) শুধু জামালপুরের গ্রামাঞ্চলেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন, ’কুয়াশাাতে’, ’দোন’, ’পাপলোশ লেবু’ প্রভৃতি অর্থ কবিতার শেষে দেয়া হয়েছে।
‘‘আলী জহির (জন্ম ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৬) একজন কবি, প্রাবন্ধিক ও সংস্কৃতিকর্মী। তার প্রকৃত নাম আলী জহির খালিকুজ্জামান। তবে সুধিমহলে তিনি আলী জহির নামে সমধিক পরিচিত।
ছাত্রজীবন থেকে তিনি প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার অধিকারী। চলমান শতকের শুরু থেকেই তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। তিনি আমার প্রিয় মানুষগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমরা যখন ২০০১-২০০২ শিক্ষাবর্ষে সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে এইচএসসি পড়তে এসেছিলাম তখন থেকেই তাকে দেখে এসেছি জামালপুরের শিল্পসাহিত্য অঙ্গনের তিনি এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। জামালপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি, বকুলতলাস্থ পাবলিক লাইব্রেরি, পৌর পাবলিক হল, দয়াময়ী মন্দিরস্থ বৈশাখী মেলার মাঠ প্রভৃতি স্থানে সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা আয়োজনে তাকে নেতৃত্বের ভূমিকায় দেখে এসেছি যা আজও অব্যাহত রয়েছে। আলী জহিরের প্রবন্ধ অনেক সমৃদ্ধ। এতে শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনের নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। তিনি নিজের সংশ্লিষ্টতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে এসবের নির্মোহ বর্ণনা তুলে ধরেছেন। তিনি যা দেখেছেন, যা অর্জন করেছেন তারই প্রতিচ্ছবি তার লেখা প্রবন্ধগ্রন্থে উঠে এসেছে। তার প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে ‘যতদূর মনে পড়ে’ (২০২০), ‘বেহেস্তের কড়চা এবং আরো কিছু’ (২০২৩) অন্যতম। আলী জহিরের কবিতায় সরল প্রাণের আবেগের প্রকাশ ঘটেছে। তার সরল প্রাণের সরল কথার গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক। তার প্রকাশিত কবিতায় মাতৃভূমি, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে আমাকে নিবেদিত ‘অবিনাশী শক্তির জোর’ শীর্ষক কবিতাটির শব্দ চয়ন ও ভাষা প্রণিধানযোগ্য।’’’- শাহ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
আমি কবি আলী জহিরের সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি।
নয়ে-ইজেনবুর্গ,
জার্মানি,
৮ই অক্টোবর, ২০২৫
আবদুল্লাহ আল-হারুন নিয়ে আরও পড়ুন
খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।