সেবা ডেস্ক: মর্মান্তিক এক সংবাদের মধ্য দিয়ে শুরু হলো শুক্রবার। দীর্ঘ ছয় দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে হার মানলেন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি।
![]() |
| না ফেরার দেশে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদি: শাহবাগে কঠোর আন্দোলনের ডাক |
সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর এই মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে, একই সঙ্গে তৈরি হয়েছে চরম উত্তেজনা।
বৃহস্পতিবার রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে ওসমান হাদির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পরবর্তীতে রাত ৯টা ৪৬ মিনিটে ইনকিলাব মঞ্চের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক আবেগঘন স্ট্যাটাসে সংগঠনের পক্ষ থেকেও তাদের নেতার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়।
ঘটনার সূত্রপাত গত শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর)। জুমাবার দুপুরে রাজধানীর পল্টন এলাকায় এক অতর্কিত হামলায় গুলিবিদ্ধ হন তরুণ রাজনীতিক ওসমান হাদি। রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে দ্রুত রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
টানা দুই দিন এভারকেয়ারের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন তিনি। তাঁর শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি এবং উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে রবিবার (১৪ ডিসেম্বর) খোদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিষয়টি নিয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেন। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান এবং এভারকেয়ার হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. জাফরের সঙ্গে ওসমান হাদির ভাই ওমর বিন হাদির এক জরুরি কনফারেন্স কল অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকেই তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুততম সময়ে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
সরকারি তত্ত্বাবধানে গত সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ওসমান হাদিকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পৌঁছানোর মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু ঘাতকের বুলেট তাঁর মস্তিষ্কে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত নিরাময় করা সম্ভব হয়নি।
সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর থেকেই চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বৃহস্পতিবার চিকিৎসকরা জানান, হাদির মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও চাপের কারণে জরুরি ভিত্তিতে একটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। পরিবারের পক্ষ থেকে সেই অস্ত্রোপচারের অনুমতিও দেওয়া হয়।
বিকেলে ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেজ থেকে জানানো হয়, "ওসমান হাদি এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। পরিবারের পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুরেই অপারেশন করবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।" কিন্তু অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতির মধ্যেই বা তার পরবর্তী জটিলতায় তিনি আর ফিরে আসেননি। বৃহস্পতিবার রাতে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
এর আগে বুধবার রাতেই প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে দেশবাসীকে জানানো হয়েছিল যে, শরিফ ওসমান হাদির শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। দেশবাসীর কাছে দোয়ার আবেদনও করা হয়েছিল। কিন্তু সব প্রার্থনা ছাপিয়ে নিয়তির বিধানই শেষ পর্যন্ত সত্য হলো।
শাহবাগে জড়ো হওয়ার ডাক ও কঠোর হুঁশিয়ারি
ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইনকিলাব মঞ্চ ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে শোকের চেয়ে ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছে বেশি। মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে দেওয়া ফেসবুক পোস্টে সংগঠনটি
পোস্টে বলা হয়েছে, "আপনারা দোয়া করুন আল্লাহ যেন তাকে হায়াতে তাইয়্যেবাহ নসীব করেন। আর ওসমান হাদি যদি রবের ডাকে সাড়া দিয়ে শহীদের কাতারে শামিল হয়, সেক্ষেত্রে পুরো বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মজলুম জনতাকে সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণে শাহবাগে জড়ো হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।"
সংগঠনটি সরকারের প্রতি আল্টিমেটাম দিয়ে জানিয়েছে, ওসমান হাদির হত্যাকারীরা গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত তারা শাহবাগে অবস্থান করবে। এমনকি পুরো বাংলাদেশ অচল করে দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে ওই পোস্টে।
ওসমান হাদির ওপর হামলা ও তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে এসেছে ইনকিলাব মঞ্চ। তাদের বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, "খুনি যদি ভারতে পালিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে যেকোনো মূল্যে তাকে গ্রেফতারপূর্বক ফেরত আনতে হবে।"
এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, ইনকিলাব মঞ্চ মনে করছে ওসমান হাদির হত্যাকারীরা দেশের বাইরে, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে পারে। ঢাকা-৮ আসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নির্বাচন সামনে রেখে একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর এমন মৃত্যু নির্বাচনী পরিবেশকে কতটা প্রভাবিত করবে, তা নিয়ে শঙ্কিত বিশ্লেষকরা। উল্লেখ্য, ঢাকা-৮ আসনে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী মির্জা আব্বাসের নামও আলোচনায় রয়েছে এবং হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মির্জা আব্বাস তাকে দেখতে হাসপাতালেও গিয়েছিলেন। তবে ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীরা তখন ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।
শরিফ ওসমান হাদি কেবল ইনকিলাব মঞ্চের আহ্ববায়কই ছিলেন না, তিনি আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন (পল্টন, মতিঝিল, শাহবাগ এলাকা) থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে ওই এলাকায় তাঁর বেশ জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুতে ওই আসনের নির্বাচনী সমীকরণে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে, ইনকিলাব মঞ্চের শাহবাগ অবরোধের ঘোষণার পর রাজধানীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। শাহবাগ মোড়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং পল্টনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করার খবর পাওয়া গেছে। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে প্রশাসন তৎপর রয়েছে।
ওসমান হাদির মৃত্যুতে শনিবার রাষ্ট্রীয় শোক
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আজ রাত সোয়া ১১টার পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শহীদ শরিফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুতে আগামী শনিবার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে বলেন, দেশের সব সরকারি আধা সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে শনিবার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। একই সঙ্গে আগামীকাল শুক্রবার বাদ জুমা দেশের প্রতিটি মসজিদে শহীদ ওসমান হাদির মাগফিরাত কামনায় বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করা হবে। অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয় গুলোতেও আয়োজন হবে বিশেষ প্রার্থনার।
শহীদ ওসমান হাদির রুহের মাগফিরাত কামনা করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি ওসমান হাদির শোকসন্তপ্ত স্ত্রী, স্বজন ও সহকর্মীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
শরিফ ওসমান হাদির স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানের দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করবে বলে ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
সিঙ্গাপুর থেকে ওসমান হাদির মরদেহ কখন দেশে আনা হবে, সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সময়সূচি জানা যায়নি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পরিবারের পক্ষ থেকে মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আজ শুক্রবার অথবা আগামীকাল শনিবারের মধ্যে তাঁর মরদেহ ঢাকায় পৌঁছাবে। এরপর জানাজা ও দাফনের সময়সূচি ঘোষণা করা হবে।
তরুণ এই রাজনৈতিক নেতার অকাল প্রয়াণ এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দেশের রাজনীতিতে নতুন কোনো মোড় নেয় কি না, সেদিকেই এখন তাকিয়ে আছে পুরো দেশ। ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীরা ইতিমধ্যেই শাহবাগের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
সূত্র: /সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশ্যে আপোষহীন
জাতীয়- নিয়ে আরও পড়ুন

আজ মহান বিজয় দিবস: বিশ্ব মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ৫৪ বছর

ভেন্টিলেশনে খালেদা জিয়া: অবস্থা সংকটাপন্ন, চলছে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়াই

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট

আজ সন্ধ্যা ৬টায় জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা

আগামীকাল সন্ধ্যা ৬টায় জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা


খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।