নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী | ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, রোববার: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) দিনভর চলা চরম উত্তেজনা, প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে অবরুদ্ধকরণ এবং শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের মুখে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন আওয়ামী লীগপন্থি ছয়জন ডিন।
![]() |
| দিনভর নাটকীয়তা ও তালাবদল: আন্দোলনের মুখে অবশেষে পদত্যাগ করলেন রাবির ৬ ডিন |
রোববার (২১ ডিসেম্বর) রাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সূত্রে এই পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এর আগে তাদের পদত্যাগের দাবিতে রোববার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নজিরবিহীন নাটকীয় ঘটনার জন্ম হয়। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টর ও রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। দিনভর নানা জল্পনা-কল্পনা ও আল্টিমেটামের পর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসুদ গণমাধ্যমকে ছয় ডিনের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
শিক্ষার্থীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করা ডিনরা হলেন—সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক এস এম এক্রাম উল্যাহ, আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবু নাসের মো. ওয়াহিদ, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ এস এম কামরুজ্জামান, বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক নাসিমা আখতার, প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক বিমল কুমার প্রামাণিক এবং ভূবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ এইচ এম সেলিম রেজা। এই ছয়জনই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল।
রবিবার সকাল থেকেই রাবি ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। গত ১৮ ডিসেম্বর এই ডিনদের দুই বছর মেয়াদি দায়িত্ব শেষ হলেও উপাচার্য তাদের মেয়াদ বৃদ্ধি করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় বিশ্বাসী সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনগুলো। বিশেষ করে সম্প্রতি জুলাই যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন নতুন করে জ্বলে ওঠে। তারা ক্যাম্পাসে আওয়ামী দোসরদের অপসারণের দাবিতে সোচ্চার হন।
দুপুর ১টার দিকে রাকসু (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) প্রতিনিধি ও একদল শিক্ষার্থী প্রথমে কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও আইন অনুষদের ডিনদের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন। এরপর তারা প্রশাসন ভবনের দিকে অগ্রসর হন। সেখানে গিয়ে উপাচার্য, দুই উপ-উপাচার্য, প্রক্টর এবং রেজিস্ট্রারের দপ্তরেও তালা মেরে দেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় প্রশাসন ভবনের ভেতরে ও বাইরে এক অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়।
আন্দোলন চলাকালে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খানের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের তীব্র বাগবিতণ্ডা হয়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষার্থীরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, মেয়াদোত্তীর্ণ এবং স্বৈরাচারের দোসর কোনো ডিনকে তারা আর এক মুহূর্তের জন্যও দায়িত্বে দেখতে চান না।
আন্দোলনের একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা জানতে পারেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার তাঁর বিভাগে ক্লাস নিচ্ছেন। খবর পেয়ে আন্দোলনকারীরা সেখানেও উপস্থিত হন এবং প্রতিবাদ জানান। রাকসুর জিএস (সাধারণ সম্পাদক) সালাহউদ্দিন আম্মারের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। ছয় ডিনের কেউ তাদের কার্যালয়ে উপস্থিত না থাকায় গণমাধ্যমকর্মীদের সামনেই জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার একে একে প্রত্যেক ডিনকে ফোনে কল করেন এবং পদত্যাগের আহ্বান জানান। তিনি তাদের উদ্দেশে লেখা একটি পদত্যাগপত্রও জনসম্মুখে পাঠ করেন।
বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। উপাচার্যের সম্মেলন কক্ষে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এই আলোচনা চলে। বৈঠকে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, অবিলম্বে ছয় ডিনকে অপসারণ না করলে তালা খোলা হবে না।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে তখন আশ্বাস দেওয়া হয় যে, সন্ধ্যায় জরুরি সভা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এই আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা সাময়িকভাবে তালা খুলে দেন। এরপর সন্ধ্যা ৭টায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেh হাসান নকীব জরুরি বৈঠকে বসেন। দীর্ঘ বৈঠকের পর রাতে ডিনদের পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকেও রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। পদত্যাগকারী এক ডিন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “উপাচার্য মহোদয় আমাদের ডেকেছিলেন। পরিস্থিতির বাস্তবতা মেনে আমরা লিখিতভাবে দায়িত্ব পালনে অপারগতার কথা জানিয়ে এসেছি। এর আগেও আমরা মৌখিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে চাই না বলে জানিয়েছিলাম।”
রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার তাঁর ফেসবুক পেজে এক পোস্টে লিখেন, “আজ মোটামুটি সব দপ্তরে আওয়ামীপন্থিদের দপ্তরগুলো তালাবদ্ধ। আমিও এটাই চাই, বিচার না হওয়া পর্যন্ত তালাবদ্ধ থাকুক। সঙ্গে সঙ্গে একটা তালিকা করেছি বিগত জুলাইয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান করা শিক্ষকদের।”
আন্দোলনে রাকসুর জিএস ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সিনেট সদস্য আকিল বিন তালেব, রাকসুর সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক জায়িদ হাসান জোহা, মিডিয়া ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসলাম, সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক রাকিবুল হাসান, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রপক্ষের আহ্বায়ক গোলাম মোস্তফা প্রমুখ।
এ বিষয়ে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহা. মাঈন উদ্দিন বিকেলে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়টি নিয়ে আমরা আগেই চিন্তাভাবনা করেছি। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অফিশিয়ালি বিষয়টি প্রক্রিয়া করার জন্যই একটু সময়ের প্রয়োজন ছিল।”
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সদ্য পদত্যাগী ডিন অধ্যাপক এস এম এক্রাম উল্যাহ দুপুরের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি এই পরিস্থিতিতে আর ডিন থাকতে চাচ্ছি না। উপাচার্যের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছি। উপাচার্য যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই চূড়ান্ত।”
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যারা শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে কাজ করেছেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো প্রশাসনিক পদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই। শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে শিক্ষার্থীদের সেই আবেগ ও ক্ষোভ আরও তীব্র হয়েছে। রাবি প্রশাসন শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সেই দাবির কাছে নতি স্বীকার করল।
এই পদত্যাগের মধ্য দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হলো। নতুন ডিন কারা হবেন এবং ক্যাম্পাসের শিক্ষার পরিবেশ কতটা দ্রুত স্বাভাবিক হবে, এখন সেটাই দেখার বিষয়।
সূত্র: /সেবা হট নিউজ: সত্য প্রকাশ্যে আপোষহীন
জাতীয়- নিয়ে আরও পড়ুন

দেশে পৌঁছেছে শহীদ ওসমান হাদির মরদেহ, জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জানাজা

না ফেরার দেশে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদি

আজ মহান বিজয় দিবস: বিশ্ব মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ৫৪ বছর

ভেন্টিলেশনে খালেদা জিয়া: অবস্থা সংকটাপন্ন, চলছে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়াই

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট


খবর/তথ্যের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, সেবা হট নিউজ এর দায়ভার কখনই নেবে না।